‘স্বায়ত্তশাসন চাওয়ায় আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে’

 


শুধু এই সরকার নয়, সেই অতীত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নানাভাবে আগ্রাসনের শিকার। আমরা সামরিক বাহিনীর নির্যাতন নিরসনে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। তখন থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন চাওয়া মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়।

শুক্রবার ( আগস্ট) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ডিনস কমপ্লেক্সেজুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর: পাহাড়-সমতলে জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যাশা প্রাপ্তিশীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা এসব কথা বলেন।

মাইকেল চাকমা বলেন, ‘সেই অতীত থেকে ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার পর থেকে একে একে পার্বত্য চট্টগ্রাম নানাভাবে আগ্রাসনের শিকার হয়। ১৮০৭ সালের আগস্টের এই দিনে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এর আগে আমাদের স্বাধীন শাসনব্যবস্থা ছিল। তারপর ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর দেশ বিভাজনের সময় আদিবাসীরা আবারও প্রতারণার স্বীকার হয়। দেশভাগের পর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তাদের যে অধিকারের সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়, তা আবারও বাতিল করা হয়।

ইউপিডিএফ-এর এই সংগঠক আরও বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২-এর সংবিধানে আমাদের বাঙালি বলা হয়। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে আমাদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তারপর জিয়া ক্ষমতায় এসে পাহাড়কে সামরিক শক্তিতে দেখতে থাকেন এবং সেখানে সামরিকায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে গণতান্ত্রিক আগ্রাসনের পরিকল্পনা আনেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন করেন, যা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে চলতে চলতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হলো। এই চুক্তির ফলেও আমরা পুনরায় প্রতারিত হলাম। আমরা যে প্রত্যাশার কথা বলছি, তা আমাদের অনেক ছিল। কিন্তু বারবার প্রত্যাশার বিপরীতে আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তার আধিপত্যবাদের যে চিন্তা, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যে সরকারই এসেছে, তারা নিজ নিজ স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে শুধু ঝুলিয়েই রেখেছে।

রাবির সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার সজন বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যে অধিকার, তা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। তারা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও প্রাপ্তির বেলায় শূন্য। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে সন্ত্রাস উচ্ছেদের নামে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিলোপ হলেও তাদের অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাবেক সভাপতি প্রদীপ মার্ডি বলেন, ‘পাহাড়িদের প্রাপ্তির প্রশ্নটা পঞ্চাশ বছরে প্রশ্ন হয়েই থেকেছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান কেউ- বহু জাতিত্ব স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ বহুজাতির হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার উপস্থিতি থাকতে হবে।’

পিসিপি রাবি শাখার সভাপতি শামীন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন পিসিপি সভাপতি অমল ত্রিপুরা, রাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাকিব হোসেন, রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে কৌশিক দাস কঙ্কন, ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকার, ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বায়ক আজাদ ইসলাম প্রমুখ।

স্বাস্থ্যসেবায় অবদান: জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন এনা মানখিনের

 


এনা মানখিন। কাজ করছেন ময়নসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার পরিবার কল্যাণ সহকারী হিসেবে। প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সহজে পৌঁছে দিতে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে গারো জনগোষ্ঠীর এই নারী ইতোমধ্যেই হয়ে উঠেছেন পরিচিত মুখ।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ময়মনসিংহ জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেছেন। পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়েও দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেন। পরিবার পরিকল্পনা ময়মনসিংহ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মতিউর রহমানের কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন।

এনা মানখিনের বাড়ি হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন হালুয়াঘাট আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে। পড়শোনা শেষে ২০১৮ সাল থেকে গ্রামের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবার পরিকল্পনার সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষৎতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে চান।  

তিনি মনে করেন, পরিবার পরিকল্পনা শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়, এটি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় তরুণদের সম্পৃক্ত করা জরুরি।

এনা মানখিন ছাড়াও বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থা, সূর্যের হাসি ক্লিনিক ও সিবিডি (পরিবার পরিকল্পনা সমিতি) ভিত্তিক মোট ২৮ জন পুরস্কাপ্রাপ্ত হন। পুরস্কার প্রাপ্তদের মাঝে প্রধান অতিথিসহ অন্যান্য অতিথিরা সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন।  

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা

 


খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন নারী উন্নয়নকর্মী শেফালিকা ত্রিপুরা। মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তাসলিমা বেগমের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নিদের্শনা দেওয়া হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এর ধারা ১৪ অনুযায়ী খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য শেফালিকা ত্রিপুরাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করা হল।

এর আগে সোমবার দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ১৪ জন সদস্যকে অবমূল্যায়ন, খারাপ আচরণ, হস্তান্তরিত বিভাগের প্রধান ও কর্মচারীদের অবমূল্যায়ন, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক বদলি, ঠিকাদার বিলের ফাইল আটকে রেখে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করা হয়। অভিযোগগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন।

সেইসঙ্গে অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের কার্যক্রম থেকে তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন শেফালিকা ত্রিপুরা।

বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক হলেন পরাগ রিছিল


 

বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন কবি ও গবেষক পরাগ রিছিল। আজ মঙ্গলবার (৮ জুলাই), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু সালেহ মোঃ মাহফুজ আলম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

আগে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক ছিলেন সুজন হাজং। চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার পর দুর্গাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোঃ নাভিদ রেজওয়ানুল কবীর একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

অন্য যেকোনো পেশা, ব্যবসা কিংবা সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংগঠন-এর সাথে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে যোগদানের তারিখ থেকে দুই বছর মেয়াদে পরিচালক পদে পরাগ রিছিলকে নিয়োগ দেয়া হয়।

পরাগ রিছিল একাধারে কবি, লেখক ও গবেষক। মান্দি জাতিসত্তার এ সংস্কৃতিজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার ও রাজনীতিতে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উম্মাচরণ কর্মকার। এছাড়াও ফুলগুলি ফুলকপির, খাবি এবং জুয়েল বিন জহিরের সাথে যৌথভাবে সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না নামে তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 

শেরপুরে বাহাছাস’র কমিটি গঠন, নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ-বিজয়

 


বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন (বাহাছাস) শেরপুর জেলা শাখার কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৫ সদস্যের জেলা কমিটিতে রামকৃষ্ণ হাজং আহ্বায়ক এবং বিজয় হাজং সদস্য সচিব হিসেবে নির্বাচিত হন।

বৃহস্পতিবার বাহাছাসের কেন্দ্রীয় সভাপতি অন্তর হাজং এবং সাধারণ সম্পাদক শ্রীবন হাজং অক্ষয় এই কমিটি অনুমোদন করেন।

কমিটির অন্য নেতারা হলেন- যুগ্ম আহ্বায়ক দ্বীপ হাজং, গীতাঞ্জলি হাজং, অনিন্দিতা হাজং, শিবা হাজং, বর্ষা হাজং, যুগান্ত হাজং, শতাব্দী হাজং, প্রান্ত হাজং ও নিলয় হাজং।

সদস্য হলেন- বিজয় হাজং, কুশল হাজং, নন্দিতা হাজং, অগনিভ সরকার, পূর্ণিমা হাজং, লিমন হাজং, সানি হাজং, অনির্বাণ হাজং, গায়ত্রী হাজং, সেজুতি হাজং, প্রশান্ত হাজং, হৃদয় হাজং, ধ্রুব হাজং, সীমা হাজং, প্রিয়ন্তি হাজং ও অলক হাজং।

গঠিত কমিটি হাজং জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষাসহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করবে বলে জানান নেতারা।

ঋতুপর্ণা ‘মেয়েদের মেসি’ বললেন বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান কিরণ

 


নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে স্বাগতিক মিয়ানমারের বিপক্ষে জোড়া গোল করে প্রশংসায় ভাসছেন ঋতুপর্ণা চাকমা। তাঁর দুটি গোলেই ২০২৬ এএফসি নারী এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিয়েছে লাল-সবুজের মেয়েরা।

চারদিকে যখন ঋতুপর্ণা চাকমার প্রশংসা তখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ তাকে তুলনা করেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘ঋতুপর্ণা আমাদের মেয়েদের মেসি। ওর বল কন্ট্রোল, গতি আর ফিনিশিং সবই অসাধারণ। বল টেনে নিয়ে যাওয়ার স্টাইলে মেসির ছায়া দেখা যায়। হামজা দেওয়ান ছেলেদের দলে যেমন তারকা, মেয়েদের দলে ঠিক তেমনিই ঋতুপর্ণা।’

এদিকে, ২০২৬ এএফসি নারী এশিয়ান কাপে লাল-সবুজের মেয়েদের জায়গা করে নেওয়াকে  ‘কঠিন পরিশ্রমের ফসল’ বলছেন কিরণ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা দারুণ কিছু করেছে। এবার লক্ষ্য হবে বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করা। সেই পরিকল্পনা আমাদের আছে এবং আমরা এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করব।

বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিকের সম্ভাবনা মাথায় রেখে এখন থেকেই কঠোর প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছেন কিরণ। তিনি বলেন, ‘এশিয়ান কাপে চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দল খেলবে। আমাদের তাদের মতো শক্ত দলের বিপক্ষে খেলতে হবে। সেজন্য আমরা ভালো প্রস্তুতির সময়টুকু কাজে লাগাতে চাই।

নিঃশব্দে বিশাল পরাগ রিছিল


মান্দি জাতিসত্তার প্রধান কবিদের একজন তিনি। চলতি আলাপের তিনি পরাগ রিছিল। বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলা কবিতা জগতের বিশাল রাজ্যেও রয়েছে উনার নিঃশব্দ পদচারণা। জীবনানন্দের হাজার বছর ধরে হাঁটা পদযাত্রীর মতোই পদ্যের পদে পদে হেঁটে রেখে চলেছেন স্মারকচিহ্ন। লেখেন বাংলা ভাষায়। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩। প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উম্মাচরণ কর্মকার’।

জুয়েল বিন জহিরের সাথে যূথবেঁধে রচনা করেছেন ‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ নামের বিষদ একটি গবেষণা গ্রন্থ। যেটি এক আকর গ্রন্থ নামে বিবেচিত হবে বলে আখ্যা দিয়েছে অনলাইন পত্রিকা ‘জনজাতির কন্ঠ’। গ্রন্থটিকে সাংসারেক ধর্মানুসারীদের বাইবেল না হলেও কাছাকাছি বলা যেতে পারে। এতে হারিয়ে যেতে বসা অচর্চিত সাংসারেক প্রথা, বিশ্বাস, রীতিনীতির কথা লিখিত আছে।

নিরহংকারী অমায়িক সদা ‘আচ্ছা’ ‘আচ্ছা’ বলা এই মানুষটির সাথে আলাপ জুড়েছিলাম ‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ দিয়ে। কথা বলতে যেয়ে একসময় বোধ হল কবির কথা তো ফুরোচ্ছে না! মুসিবতে পড়লাম। থেমে থেমে বলতেই থাকেন, কথা মেশিনের মতো। ছোটবেলা বলা মুরুব্বির কথাখানা মনে এল, পড়েছো মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে। আলাপ যখন করতে এসেছি তখন আলাপ তো শুনতেই হবে। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা মনোযোগী ছাত্রের মতোন লেকচার শুনতে থাকলাম নিবিষ্ট চিত্তে। সুই সুতোয় গাথা ফুলের মতো একে একে সেলাই করে চলেছেন শব্দমালা। কথামালায় উঠে এসেছে সাংসারেক মান্দিদের রীতিনীতি-প্রথা, আচার-বিশ্বাস, তরুণদের লেখালেখি, মান্দি শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা অনগ্রসর প্রান্তিক মেহনতী মানুষদের অধিকারহীনতার বিষয়গুলোও।

‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ সম্পর্কে জানতে চাইলাম।

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিবাট্টায় কথার ঝাঁপি খুললেন, ‘‘ওয়ান্না মান্দিদের প্রধান উৎসব। মাঝে মান্দি সমাজে ওয়ান্না পালন হচ্ছিল না, এখন বিভিন্ন জায়গায় ওয়ানগালা পালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ওয়ানগালা কীভাবে পালিত হয় তা বেশির ভাগ মান্দির কাছেই অজানা। ওয়ান্নার আসল এসেন্স বর্তমান খুব কম মান্দিই জানে।

ওয়ানগালা শব্দটা লোকে যেভাবে জানে তার তাৎপর্য কম লোকই জানে। কথার কথা, নকমান্দি শব্দটার সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু নকমান্দির জন্য কী কী উপাদান বা বৈশিষ্ঠ্য থাকা লাগে কিংবা কী উপাদান থাকলে নকমান্দি হয়ে উঠে তা অজানা। বিষয়টা এরকমই। বর্তমানে ওয়ানগালায় এমন কিছু সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে যার সাথে প্রকৃত ওয়ানগালার যোগসূত্র নাই। অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস সংস্কৃতি বিকৃতির মতো ঘটনাও জ্ঞাতে অজ্ঞাতে ঘটে যাচ্ছে। অনেক কিছুর সংমিশ্রণ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে জগাখিচুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে। এজন্যে নতুন প্রজন্ম যাদের ওয়ানগালা সম্পর্কে আসল ধারণা নেই, তারা যেন প্রকৃত ওয়ানগালার রূপ সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্যে এই প্রচষ্টা। এই বই পড়ে কিছুটা হলেও ওয়ান্না সম্পর্কে জানতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।’’

একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর তুমুল প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে কেন মনে হলো যে, সাংসারেকদের নিয়ে বই লেখা দরকার?

সদুত্তর দিলেন দার্শনিক কায়দায়। বললেন, ‘‘বর্তমান বিশ্বের চলতি ইস্যু প্রেক্ষিতে যদি বলা হয়, আমাজন বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে সেখানকার স্থানীয় মুর‌্যাল আদিবাসীরা যুদ্ধ করছেন কেবলমাত্র বন প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্যে। বন প্রকৃতির সাথে আদিবাসী মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, আত্মিক। আদিবাসী মাত্রই বিশ্বাস করে, বন না থাকলে তারাও থাকবে না, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। পৃথিবীর সব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা ধর্ম আছে কিন্তু তাকে যদি এক কথায় সর্বপ্রাণবাদ বা ‘এক জীবন চক্র’ বলি তবে দেখবো সব প্রাণীর জীবন চক্র একই। আদিবাসীদের সব প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ, অনুভূতি একই। আদিবাসীরা ভাবে সব প্রাণীর জীবন আছে, মমতা ভালোবাসা একই। সব প্রাণীকে সমানভাবে ভালবাসতে হয় এই বোধ আদিবাসীদের প্রবল।

পৃথিবীকে ভালোভাবে রাখতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। একে এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু পুজিঁবাদী ব্যবসায়ী দখলদারেরা কখনোই জানে না বা জানতে চায় না প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। প্রকৃতির একটা অংশ হিসেবে কীভাবে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হয়, যত্ন করে রাখতে হয় তা তারা জানে না। এইসব নানা কারণে সাংসারেকদের নিয়ে বই লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশ মেঘ গাছপালা বাতাস শোভিত সাজেক পাহাড়কে ম্রো আদিবাসীরা পবিত্র ভূমি হিসেবে মানে। ম্রোদের বিশ্বাস সেখানে তাদের পূর্বপুরুষ শান্তিতে বসবাস করেন। এজন্যে এতোকাল ধরে তারা জায়গাটিকে অত্যন্ত যত্ন করে রেখে এসেছে। কিন্তু বাইরের কর্পোরেট দুনিয়া তাকে দূষিত করে ফেলে। বাইরের মানুষের জন্যে বিনোদনের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলে। এখানেই আদিবাসী ও অ-আদিবাসী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশাল ফারাক। আদিবাসী মন-মনন গভীরভাবে উপলব্দি থেকে এই বই লেখার প্রচেষ্টা।’’

একটি সহজ বোঝপড়ায় উনিশ বিশ আছে যে, ওয়ান্না এবং ওয়ানগালা কী আলাদা না একই?

একবাক্যে বলে দিলেন, ‘‘ওয়ান্না এবং ওয়ানগালা বিষয়টা একই। নামগত তফাৎ এই যা। বলা হতো, ঐ গ্রামে ওয়ান্না হবে, আর ওয়ানগালার শেষ দিন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কাঠিগুলো পরবর্তী ওয়ান্না না হওয়া পর্যন্ত বিদেয় জানিয়ে ফেলে দেয়া হয়। আমার ধারণা, গালা (ফেলে দেয়া) শব্দটি কালক্রমে যুক্ত হয়।’’

মান্দি সমাজ বর্তমানে বিভিন্ন পরিচয়ের বেড়াজালে আবদ্ধ। যেমন- সাংসারেক মান্দি, খ্রিস্টান মান্দি আবার খ্রিস্টানদের মধ্যেও ব্যাপ্টিস্ট, রোমান ক্যাথলিক, চার্চ অব বাংলাদেশ, যিহুবা সাক্ষী ইত্যাদি নানান ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ। এগুলো অনেক সময় মান্দিদের মধ্যে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল তৈরী করে। ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাধাঁ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

হ্যাঁ, এটা ঠিক বর্তমান মান্দি সমাজ খ্রিস্টান ধর্মের নানান উপ-পরিচয়ে আবদ্ধ। এই পরিচয় গুলো সামাজিক ফারাক তৈরী করে। আমি এমনও দেখেছি, ছেলে ব্যাপ্টিস্ট মেয়ে ক্যাথলিক কিংবা মেয়ে ব্যাপ্টিস্ট ছেলে ক্যাথলিক এজন্যে তাদের বিয়ে হচ্ছে না, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে। এইসব সামাজিক বন্ধন তৈরীতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

অন্যদিকে, খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের জাতীয় বোধ কমে যাচ্ছে। এটা হয়তো, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দীনতার ফলেই হচ্ছে। গারোদের জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি নেই, গারোদের অর্থনৈতিক শক্ত কাঠামো থাকা দরকার। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে করতে হবে। তবেই জাতীয় পরিচয়, জাতীয় বোধ তৈরী হবে। এতে করে পার্শ্ব পরিচয়গুলো গুরুত্বহীন দুর্বল হয়ে পড়বে।

মান্দিদের বর্তমান শিল্প-সাহিত্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?

মান্দি শিল্প সাহিত্যে অনেক তরুণ যুক্ত হচ্ছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু সন্তুষ্ট না একটা কারণে। কারণ প্রত্যেক ম্যাগাজিনগুলো পড়লে দেখা যায়, কমন লেখকদের লেখা। ম্যাগাজিন খুলেই নতুন লেখকের লেখা দেখলে খুব খুশি হবো।

(২০২০ সালের কোন একদিন নিরিবিলি কবির সাথে লেখকের আড্ডা হয়। গতকাল (৩ জুলাই) ছিল কবির জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে দীর্ঘ আলাপটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল)

লেখক: উন্নয়ন ডি. শিরা।

© all rights reserved - Janajatir Kantho