মান্দি জাতিসত্তার প্রধান কবিদের একজন তিনি। চলতি আলাপের তিনি পরাগ রিছিল। বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলা কবিতা জগতের বিশাল রাজ্যেও রয়েছে উনার নিঃশব্দ পদচারণা। জীবনানন্দের হাজার বছর ধরে হাঁটা পদযাত্রীর মতোই পদ্যের পদে পদে হেঁটে রেখে চলেছেন স্মারকচিহ্ন। লেখেন বাংলা ভাষায়। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩। প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উম্মাচরণ কর্মকার’।
জুয়েল বিন জহিরের সাথে যূথবেঁধে রচনা করেছেন ‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ নামের বিষদ একটি গবেষণা গ্রন্থ। যেটি এক আকর গ্রন্থ নামে বিবেচিত হবে বলে আখ্যা দিয়েছে অনলাইন পত্রিকা ‘জনজাতির কন্ঠ’। গ্রন্থটিকে সাংসারেক ধর্মানুসারীদের বাইবেল না হলেও কাছাকাছি বলা যেতে পারে। এতে হারিয়ে যেতে বসা অচর্চিত সাংসারেক প্রথা, বিশ্বাস, রীতিনীতির কথা লিখিত আছে।
নিরহংকারী অমায়িক সদা ‘আচ্ছা’ ‘আচ্ছা’ বলা এই মানুষটির সাথে আলাপ জুড়েছিলাম ‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ দিয়ে। কথা বলতে যেয়ে একসময় বোধ হল কবির কথা তো ফুরোচ্ছে না! মুসিবতে পড়লাম। থেমে থেমে বলতেই থাকেন, কথা মেশিনের মতো। ছোটবেলা বলা মুরুব্বির কথাখানা মনে এল, পড়েছো মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে। আলাপ যখন করতে এসেছি তখন আলাপ তো শুনতেই হবে। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা মনোযোগী ছাত্রের মতোন লেকচার শুনতে থাকলাম নিবিষ্ট চিত্তে। সুই সুতোয় গাথা ফুলের মতো একে একে সেলাই করে চলেছেন শব্দমালা। কথামালায় উঠে এসেছে সাংসারেক মান্দিদের রীতিনীতি-প্রথা, আচার-বিশ্বাস, তরুণদের লেখালেখি, মান্দি শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা অনগ্রসর প্রান্তিক মেহনতী মানুষদের অধিকারহীনতার বিষয়গুলোও।
‘সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না’ সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিবাট্টায় কথার ঝাঁপি খুললেন, ‘‘ওয়ান্না মান্দিদের প্রধান উৎসব। মাঝে মান্দি সমাজে ওয়ান্না পালন হচ্ছিল না, এখন বিভিন্ন জায়গায় ওয়ানগালা পালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ওয়ানগালা কীভাবে পালিত হয় তা বেশির ভাগ মান্দির কাছেই অজানা। ওয়ান্নার আসল এসেন্স বর্তমান খুব কম মান্দিই জানে।
ওয়ানগালা শব্দটা লোকে যেভাবে জানে তার তাৎপর্য কম লোকই জানে। কথার কথা, নকমান্দি শব্দটার সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু নকমান্দির জন্য কী কী উপাদান বা বৈশিষ্ঠ্য থাকা লাগে কিংবা কী উপাদান থাকলে নকমান্দি হয়ে উঠে তা অজানা। বিষয়টা এরকমই। বর্তমানে ওয়ানগালায় এমন কিছু সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে যার সাথে প্রকৃত ওয়ানগালার যোগসূত্র নাই। অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস সংস্কৃতি বিকৃতির মতো ঘটনাও জ্ঞাতে অজ্ঞাতে ঘটে যাচ্ছে। অনেক কিছুর সংমিশ্রণ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে জগাখিচুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে। এজন্যে নতুন প্রজন্ম যাদের ওয়ানগালা সম্পর্কে আসল ধারণা নেই, তারা যেন প্রকৃত ওয়ানগালার রূপ সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্যে এই প্রচষ্টা। এই বই পড়ে কিছুটা হলেও ওয়ান্না সম্পর্কে জানতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।’’
একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর তুমুল প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে কেন মনে হলো যে, সাংসারেকদের নিয়ে বই লেখা দরকার?
সদুত্তর দিলেন দার্শনিক কায়দায়। বললেন, ‘‘বর্তমান বিশ্বের চলতি ইস্যু প্রেক্ষিতে যদি বলা হয়, আমাজন বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে সেখানকার স্থানীয় মুর্যাল আদিবাসীরা যুদ্ধ করছেন কেবলমাত্র বন প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্যে। বন প্রকৃতির সাথে আদিবাসী মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, আত্মিক। আদিবাসী মাত্রই বিশ্বাস করে, বন না থাকলে তারাও থাকবে না, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। পৃথিবীর সব আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা ধর্ম আছে কিন্তু তাকে যদি এক কথায় সর্বপ্রাণবাদ বা ‘এক জীবন চক্র’ বলি তবে দেখবো সব প্রাণীর জীবন চক্র একই। আদিবাসীদের সব প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ, অনুভূতি একই। আদিবাসীরা ভাবে সব প্রাণীর জীবন আছে, মমতা ভালোবাসা একই। সব প্রাণীকে সমানভাবে ভালবাসতে হয় এই বোধ আদিবাসীদের প্রবল।
পৃথিবীকে ভালোভাবে রাখতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। একে এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু পুজিঁবাদী ব্যবসায়ী দখলদারেরা কখনোই জানে না বা জানতে চায় না প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। প্রকৃতির একটা অংশ হিসেবে কীভাবে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হয়, যত্ন করে রাখতে হয় তা তারা জানে না। এইসব নানা কারণে সাংসারেকদের নিয়ে বই লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশ মেঘ গাছপালা বাতাস শোভিত সাজেক পাহাড়কে ম্রো আদিবাসীরা পবিত্র ভূমি হিসেবে মানে। ম্রোদের বিশ্বাস সেখানে তাদের পূর্বপুরুষ শান্তিতে বসবাস করেন। এজন্যে এতোকাল ধরে তারা জায়গাটিকে অত্যন্ত যত্ন করে রেখে এসেছে। কিন্তু বাইরের কর্পোরেট দুনিয়া তাকে দূষিত করে ফেলে। বাইরের মানুষের জন্যে বিনোদনের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলে। এখানেই আদিবাসী ও অ-আদিবাসী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশাল ফারাক। আদিবাসী মন-মনন গভীরভাবে উপলব্দি থেকে এই বই লেখার প্রচেষ্টা।’’
একটি সহজ বোঝপড়ায় উনিশ বিশ আছে যে, ওয়ান্না এবং ওয়ানগালা কী আলাদা না একই?
একবাক্যে বলে দিলেন, ‘‘ওয়ান্না এবং ওয়ানগালা বিষয়টা একই। নামগত তফাৎ এই যা। বলা হতো, ঐ গ্রামে ওয়ান্না হবে, আর ওয়ানগালার শেষ দিন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কাঠিগুলো পরবর্তী ওয়ান্না না হওয়া পর্যন্ত বিদেয় জানিয়ে ফেলে দেয়া হয়। আমার ধারণা, গালা (ফেলে দেয়া) শব্দটি কালক্রমে যুক্ত হয়।’’
মান্দি সমাজ বর্তমানে বিভিন্ন পরিচয়ের বেড়াজালে আবদ্ধ। যেমন- সাংসারেক মান্দি, খ্রিস্টান মান্দি আবার খ্রিস্টানদের মধ্যেও ব্যাপ্টিস্ট, রোমান ক্যাথলিক, চার্চ অব বাংলাদেশ, যিহুবা সাক্ষী ইত্যাদি নানান ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ। এগুলো অনেক সময় মান্দিদের মধ্যে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল তৈরী করে। ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাধাঁ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
হ্যাঁ, এটা ঠিক বর্তমান মান্দি সমাজ খ্রিস্টান ধর্মের নানান উপ-পরিচয়ে আবদ্ধ। এই পরিচয় গুলো সামাজিক ফারাক তৈরী করে। আমি এমনও দেখেছি, ছেলে ব্যাপ্টিস্ট মেয়ে ক্যাথলিক কিংবা মেয়ে ব্যাপ্টিস্ট ছেলে ক্যাথলিক এজন্যে তাদের বিয়ে হচ্ছে না, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে। এইসব সামাজিক বন্ধন তৈরীতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
অন্যদিকে, খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের জাতীয় বোধ কমে যাচ্ছে। এটা হয়তো, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দীনতার ফলেই হচ্ছে। গারোদের জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি নেই, গারোদের অর্থনৈতিক শক্ত কাঠামো থাকা দরকার। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে করতে হবে। তবেই জাতীয় পরিচয়, জাতীয় বোধ তৈরী হবে। এতে করে পার্শ্ব পরিচয়গুলো গুরুত্বহীন দুর্বল হয়ে পড়বে।
মান্দিদের বর্তমান শিল্প-সাহিত্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
মান্দি শিল্প সাহিত্যে অনেক তরুণ যুক্ত হচ্ছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু সন্তুষ্ট না একটা কারণে। কারণ প্রত্যেক ম্যাগাজিনগুলো পড়লে দেখা যায়, কমন লেখকদের লেখা। ম্যাগাজিন খুলেই নতুন লেখকের লেখা দেখলে খুব খুশি হবো।
(২০২০ সালের কোন একদিন নিরিবিলি কবির সাথে লেখকের আড্ডা হয়। গতকাল (৩ জুলাই) ছিল কবির জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে দীর্ঘ আলাপটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল)
লেখক: উন্নয়ন ডি. শিরা।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন