মুক্তমত লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মুক্তমত লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রাষ্ট্র বনাম চেতনা

আদিবাসী জনগোষ্ঠী কারা


প্রিয় লেখক কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার ‘পাহাড়ী জনপদে জীবনের অন্বেষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন

‘‘কথা ছিল বাংলাদেশের ভাগে যে আকাশটুকু পড়েছে তার অধিকার সব মানুষের সমান থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল দেশের প্রধান জাতিসত্তার মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। থাকেনি।

কথা ছিল সামরিক বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না পাহাড়ী মানুষের জীবন। হয়নি।

কথা ছিল একটি শান্তি চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে পরিপূর্ণ শান্তি আনা হবে বিদ্রোহী জনপদের অশান্ত মানুষের হৃদয়ে। হয়নি।

কথা ছিল সব নৈরাজ্যের অবসান শেষে পাহাড়ী আদিবাসীদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। হয়নি।’’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আইএলও কনভেশন নং-১০৭ র‌্যাটিফাই করেন। এই কনভেনশনে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমির মালিকানা ও অধিকার স্বীকৃত। দুঃখের বিষয়, এই কনভেশনের আলোকে এখনো এই রাষ্ট্র সরকার কনভেনশন বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কনভেনশনে বলা আছে, আদিবাসীদের কাগজ ও দলিল থাকুক বা না থাকুক যে জমি তারা ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করে আসছে সে জমির অধিকার তাদের, মালিকানা তাদের। বঙ্গবন্ধুর পর বাকি সরকারগুলো বাকি কাজগুলো আর করেনি। মুদি দোকানির মতো বাকি রেখে দিয়েছেন।

১৯৬২ সালের তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ৮ ফুট উঁচু কাঁটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করেছিলেন ৬০ কি.মি মধুপুরের শালবনে। ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈনিক এম এল প্রশান্ত তার ফিরে দেখা নামক লেখায় জানিয়েছেন, ‘মধুপুরে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ ২০০২ থেকেই শুরু করে বনবিভাগ। রসুলপুর থেকে মাপ যোগ করে আদিবাসী গ্রাম সাঁতারিয়া পর্যন্ত যখন পৌঁছে তখন স্থানীয় জনগণ বাধা প্রদান করে। এতে নেতৃত্ব দেন যতীশ দফো, ইলিপ চাম্বুগং, মার্থা চাম্বুগংসহ আরো কয়েকজন। এপ্রিলের ২০০৩ সালে আবার দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করেন এইসব পয়েন্টগুলোতেরসুলপুর, সাতারিয়া, জালাবাদা, সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি, লোহরিয়া, ধলিবাইদ বাদরবাগ।’

আবিমার সকল সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব ভূমি রক্ষার জন্যে সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং মিছিল মিটিং মানববন্ধন শুরু করে। অপর দিকে বনবিভাগ শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সপ্তাহব্যাপী সকল এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। কালো পতাকা উত্তোলন করে ০৩/০১/২০০৪ তারিখ শান্তিপূর্ণ মৌন মিছিল বের হয়। সাধুপাড়া জালাবাদা হয়ে গায়রা স্কুলে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম, সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষের মিছিল রাজঘাট নামক স্থানে পৌঁছালে বিনা প্ররোচনায় বনরক্ষক ও পুলিশ মিলিত প্রয়াসে বিনা উস্কানিতে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান শহীদ পিরেন স্নাল, চির পঙ্গুত্ব বরণ করেন গারো যুবক বীর উৎপল নকরেক। এসময় অর্ধ-শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। স্বাধীন রাষ্ট্রের এমন বর্বর নৃশংস আচরণ ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এটি মহান ৭১-এর চেতনার পরিপন্থী।

ইতিহাস নাড়াচাড়া করে আমরা দেখতে পাই, অতীতে আদিবাসীদের একের পর এক মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। বর্তমানে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে জমি ভূমি, বসতভিটা। হরণ করা হয়েছে আদিবাসীদের সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের কোটা পদ্ধতি। আদিবাসী বান্ধব সরকার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসীদের নিয়ে রাজনীতির গুটি নাড়ছে।

আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনের দোখলায় বাংলাদেশের সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া রচিত হয়েছিল। কত যন্ত্রণায় প্রাপ্ত সেই সংবিধানে ঠাঁই হয়নি মধুপুরে অবস্থিত গারো তথা সমগ্র আদিবাসীর আত্মপরিচয় এবং ভূমির অধিকার। এই রাষ্ট্রের বর্তমান ৭১-এর চেতনা নামক ফুলের স্ফুলিঙ্গ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে একাত্তরের প্রকৃত আদর্শধারীরা। একাত্তরের চেতনা কি এই ছিল যে, ধর্ম ব্যক্তি পর্যায় পেরিয়ে রাষ্ট্র ধর্মান্তরিত হোক? রাষ্ট্রের ধর্ম হোক একটা গোষ্ঠীর! আজ অসাম্প্রদায়িকতা কোথায়? আমি খুঁজে বেড়াই।

রাষ্ট্রকে ধর্মান্তরিত করার এমন আচরণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা চুপ ছিলেন। মৌন ছিলেন তথাকথিত আদিবাসী সরকারি নেতারাও। আবার আদর্শিক গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধারা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ধর্মের জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে দেশ স্বাধীন করিনি। এখানে গান্ধীজীর একটা কথা স্বরণযোগ্য, ‘‘কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থান দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে তার পরিমান জানা।’’ গান্ধীর এই উক্তির মাপকাঠিতে পরিস্কার দেখা যায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা জুড়ে স্বাধীনতার সুবাতাস বইলেও আদিবাসীদের গায়ে সেই বাতাস লাগে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আদিবাসী অধিকারের জন্য যে লড়াই তা গারো বা মারমা ত্রিপুরা চাকমাদের একার নয়, এটা সমগ্র জাতির সামষ্টিক লড়াই। রাষ্ট্র যতো এই উপলব্ধি করবে ততোই সে উন্নত হবে।

এদেশে যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা বৈষম্য বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনায় গ্রাস করা হয়েছে আদিবাসীদের অস্তিত্ব। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রত্যেক সরকারই তাদের সুবিধা মতোন আদিবাসীদের ব্যবহার করেছে। নির্বাচন আসলে একগাদা ইশতেহার দিয়ে বাদঁর নাচা নাঁচায়, বাস্তবে অধিকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ ছিঁটেফোটাও নেই। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা বা তুচ্ছ জ্ঞান করে রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না। সবাই এগিয়ে গেলেই রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে এগোতে হলে আদিবাসী সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। এটি ভাবনার বিষয়।

বাঙালি পাকিস্তানের জাতি-ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিই আদিবাসীদের ওপর একই নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা কলুষিত।

মহান সংবিধানকে এই সত্য মানতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের বৈচিত্র্যপ‚র্ণ দেশ। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট বাঙালি জাতির মতো মিথ্যা কলুষিত অসত্য বাক্য। এর বিপরীতে বলতে হয়, বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা, একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বসবাস করে, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা আছে এবং সে ভাষায় তারা কথা বলে। সংশোধিত সংবিধানে দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষাকে পরিত্যাজ্য করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে এক ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করে আঘাত করা হয়েছে দেশের বহু মাত্রিক বৈচিত্র্যকে। মাতৃভাষার জন্যে যারা রক্ত দিয়েছে তাদের কাছেও অন্য মাতৃভাষা নিরাপদ নয়। বিষয়টা ভাবতেই কষ্ট লাগে। এ লজ্জা কার? এদেশের বর্তমান রীতিনীতি এদেশের ম‚ল চেতনারই পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে দুর্নীতিই এখন নীতি। রাষ্ট্র বনাম চেতনা সাংঘর্ষিক।

লেখা শেষ করতে চাই প্রিয় কবি লেখক রফিক আজাদের কবিতা দিয়ে। ১৯৭৬ সালের মে মাসে রফিক আজাদ রচনা করেছিলেন মধুপুরের শালবনের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতাটি

‘‘স্পর্শকাতর এই নাম

উচ্চারণ মাত্র যেন ভেঙে যাবে,

অন্তর্হিত হবে তার মহিমা-

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্ত স্নিগ্ধ পূর্নিমার চাঁদ।

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি।

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।’’

কবির সময়ের উপলব্ধি, তিনি হিংস্রতা দেখেনি! কবি কি জানে বর্তমানে কত হিংস্রতায় ভরা চুনিয়া? ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার জাতীয় উদ্যান গড়েছিল গারো কোচদের ভূমিতে। কাগজে কলমে এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ছিল বন সংরক্ষণ উন্নয়ন। বাস্তবে ছিল গারো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা এবং তা কার্যসিদ্ধির জন্য পাকিস্তান সরকারের পর এই স্বাধীন বাংলার সরকার ২০০৪ সালে যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা এক ভয়ানক হিংস্র রূপ। এজন্যেই আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং আক্ষেপে বলেছেন, ‘মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদ প্রিয় লোকদের বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমণের জন্যে উপযুক্ত জায়গা, আদিবাসীদের জন্য অনুপযুক্ত। বনের আদি অধিবাসী গারো, কোচদের জীবন হুমকিতে।’

লেখক: নিগূঢ় ম্রং, কবি ও লেখক। 

উন্নয়নের রাজনীতি ও উন্নয়নের আগ্রাসন: প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম

উন্নয়নের রাজনীতি ও উন্নয়নের আগ্রাসন

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পর্যটকরা যখন রকমারি পাহাড়ি খাবার খাচ্ছেন, ঠিক তখনই হয়তো অদূরে অন্য এক পাহাড়ে পাহাড়িরা উপোস করে আছেন।

সাজেকের দুর্গম গ্রামগুলোতে প্রতি বছর খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সীমানাঘেঁষা ২০-২৫টি গ্রামের প্রায় চার শত মানুষ বছরের একটা সময় ভাতের অভাবে জঙ্গলের আলু, ফল খাবার সংগ্রহ করে খায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে এক অন্যরকম বিসদৃশ্য চিত্র দেখা যায়।

এখন বান্দরবানে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বীর বাহাদুর এমপি বলেছিলেন, ‘‘বান্দরবানে এক ইঞ্চিও খালি জায়গা রাখা হবে না, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে পার্বত্য এ (বান্দরবান) জেলা।’’

সরকার ও সেনাবাহিনীর একমাত্র এজেন্ডা যেন আদিবাসীদের উন্নয়ন। তারা গণমাধ্যমে একদিকে জোরে উন্নয়নের ঢাক বাজাতে থাকেন, অন্যদিকে আদিবাসী প্রান্তজন চলে যান রাষ্ট্রীয় প্রান্তের ওপারে। পাহাড়িরা যখন দলে দলে ক্ষুধা আর দারিদ্রে জেরবার হয়ে দেশান্তরি হন তখন সরকারের বাজানো উন্নয়নের ঢাক উপহাসের সুরে বাজতে থাকে।

সরকারের এমনই উন্নয়ন যে উন্নয়নের উৎপীড়নে পাহাড়িদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। গত বছর এভাবে মিয়ানমারে পালাতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে একজন ম্রো আদিবাসী মারা গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে ‘একাত্তর টিভি’তে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, খাদ্য সংকটের কারণে গত তিন বছরে শতাধিক পরিবারের প্রায় পাঁচশ আদিবাসী দেশ ছেড়ে গেছেন।

লেখক এবং সমাজকর্মী কংচাই মারমা ২০১৮ সালের মার্চ মাসে এক ফেসবুক নোটে দেশত্যাগী ম্রো আদিবাসীদের কথা তুলে ধরেছেন। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খাদ্যাভাব, জীবিকার সংকট, জীবনযাপনের সংকটে তাঁরা দেশ ত্যাগ করেছেন। বোমা নয়, গুলি নয়, উন্নয়ন! উন্নয়নের উৎপীড়নে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি’তে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে সাজেক পর্যটন এলাকার গ্রামপ্রধান অনিশ্চিত, ভয়ংকর এক ভবিষ্যতের আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘আগে যেখানে ১২০ পরিবার পাংখো, লুসাই জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলো এখন সেখানে আছে মাত্র ১০ পরিবার। সামনের দিনে টিকতে পারবো কিনা বলা যায় না।”

প্রতিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন আধুনিকায়নের ফলে পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনযাপন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় পাহাড়িরা ভিটেমাটি ছাড়ছেন। লেখক গবেষক হাবিবুর রহমান প্রতিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়নকে পাহাড়িদের খাদ্যাভাব ও দেশত্যাগের জন্য দায়ী করেছেন। বাণিজ্যিক বৃক্ষায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ব্যাহত হয়। রাবার গাছ, সেগুন গাছের মতো বাণিজ্যিক বৃক্ষায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়। একটা প্রাকৃতিক বনের মাটির উপরে থাকা কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে মাটির অনুজীব সকলেই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করে। পাহাড়িদের জুম চাষ সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতি। ফুলের পরাগায়ণ থেকে শুরু করে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ, তার সবকিছুই প্রকৃতি নির্ভর। সারা দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষিজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তাই জুম চাষের ভবিষ্যত একেবারেই অনিশ্চিত। রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন মূলত রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি ও সংখ্যালঘু জাতিরই উন্নয়ন দর্শন। সেই দর্শন দুর্গম আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দর্শন নয়।

‘ঝগড়াপুর: পুওর পিজ্যান্টস অ্যান্ড উইমেন ইন এ ভিলেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের লেখক সমাজবিজ্ঞানী ইয়েনেকে আরেন্স পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে ‘উইনিং হার্টস অ্যান্ড মাইন্ডস: ফরেন এইড অ্যান্ড মিলিটারাইজেশন ইন দ্য চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের পেছনে যে উন্নয়নের রাজনীতি আছে তা সাধারণত চাক্ষুষ আলোচনায় আসে না। আরেন্স-এর রচনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়ন রাজনীতি, উন্নয়নের রেটরিক ও জাতীয়তার ন্যারেটিভের সম্পর্ক উন্মোচন করে। সত্তর-আশির দশকে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গণহত্যা আর বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে বিদেশি ত্রাণের টাকা দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নত করতে যে বিদেশি ত্রাণ এসেছিলো, তা ব্যয় হয়েছে পাহাড়ের সামরিকায়ন আর সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মিত অবকাঠামো নির্মাণে। সামরিক রণনীতি অনুযায়ীই এইসব অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে।’’

দুস্তর পাহাড়, বন ভেদ করে যে রাস্তা চলে দুর্গম পাহাড়ি জনপদে- সেই রাস্তা দিয়েই গেছে সামরিক বাহিনীর কনভয় এবং বাঙালি সেটলারদের ট্রাক। এই রাস্তা দিয়েই বাংলাদেশের পুঁজিবাদী শোষণের রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত দুর্গম এলাকা উন্নয়নের নামে সমুদয় বৈদেশিক ডলার আদিবাসীদের কোনো কাজেই আসেনি, তা কাজে লেগেছে সেনাবাহিনীর ইনসার্জেন্সি দমন করতে, আদিবাসী অর্থনীতি ধ্বংস করতে আর বাজার অর্থনীতির কালো হাত সম্প্রসারণ করতে। কাউন্টার ইনসার্জেন্সির অন্যতম কৌশল হচ্ছে পেসিফিকেশন বা শান্তকরণ, অর্থাৎ ‘শত্রুর মন ও হৃদয় জয় করা’, মানে শান্তির-স¤প্রীতির ধোঁকা-ছলনা। পাহাড়ের আনাচে কানাচে সেনাবাহিনীর বানানো সব মন জয় করা প্রকল্পগুলো ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তা বানানোর উদ্দেশ্য, সেই রাস্তা দিয়ে তাদের সৈন্য ও রসদ পৌঁছানো। স্কুল, মন্দির বানানোর উদ্দেশ্য এলাকার মানুষের মন জয় করা। কমিউনিটির ভিত্তিতে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বানানো- অর্থাৎ, মারমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো ইত্যাদি জাতিগতভাবে শ্রেণিকরণ করে উন্নয়নের পয়সা বিতরণের উদ্দেশ্য জাতিগতভাবে আদিবাসীদের ভাগ করা আর শাসন করা। তাই সাদা চোখে যাকে শান্তি-সম্প্রীতি-উন্নয়ন মনে হয়, তার পেছনে দমন-পীড়ন-শোষণের ষড়যন্ত্র রয়েছে।

রাষ্ট্রের এই উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতিকে উন্মোচিত করা প্রত্যেক দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবির কর্তব্য। রাষ্ট্রের উন্নয়ন রাজনীতির স্থানিক-কালিক ও বহুমাত্রিক রূপভেদ উন্মোচন এই ছোট লেখায় ধারণ করা সম্ভব না। কীভাবে সরকারি কালো পিচের রাস্তা দুর্গম বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সেখানকার আদিবাসীদের শোষণ করে, কীভাবে আদিবাসী অর্থনীতিকে বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা হয়, কীভাবে পর্যটন আদিবাসীদের শোষণ করছে- এর একেকটি বিষয় নিয়েই বিস্তৃত গবেষণা হতে পারে।

এই লেখায় আমি উন্নয়ন আগ্রাসনের সাথে রাষ্ট্রের চলমান উন্নয়ন রাজনীতি এবং পর্যটনের সম্পর্ক সংক্ষেপে তুলে ধরবো। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন অনুযায়ী গৃহীত নীতিমালা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ফলে আদিবাসীদের প্রান্তিকীকরণ হচ্ছে। এসব নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রান্তিক আদিবাসীদের নূন্যতম অংশগ্রহণ নেই। যেমন সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের ৯ (ড) ধারায়, কালচারাল ট্যুরিজম ডেভেলপ করার জন্য বলা হয়েছে। গবেষক পাভেল পার্থ ‘আদিবাসী সংস্কৃতি মানে পর্যটন ব্যবসা?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনটি পাঠে মনে হয় আদিবাসী জনগণের জীবন সংস্কৃতি কেবল জাদুঘর, মঞ্চ বিনোদন আর পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্যই।

প্রতিবছর পার্বত্য এলাকায় লোক শিল্পমেলা থেকে শুরু করে আদিবাসী সংস্কৃতি রক্ষা ও প্রদর্শনীর বহর দেখে মনে হয় আদিবাসী সংস্কৃতি যেন সংখ্যাগুরুর কাছে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের পসরা। এই আইনে আদিবাসী সংস্কৃতির বিকাশ ও বাজারজাত করার বিধান থাকলেও তা রক্ষার কোনো কথা নেই। বিকৃতি ও চুরি থেকে আদিবাসীদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জ্ঞান রক্ষার বিধি-বিধান নেই। বাজারমুখীনতাই আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চার শেষ কথা। সংস্কৃতির এই বাজারজাতকরণ বা কালচারাল ট্যুরিজম ও এথনিক ট্যুরিজম আদিবাসী জনপদে ইতোমধ্যেই বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।’’

প্রাবন্ধিক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: কারও বিনোদন কারও হুতাশন’ শীর্ষক লেখায়ও পর্যটনের কুফল কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে।

রাষ্ট্রের উন্নয়ন পলিসি, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অনেক সময় আদিবাসীদের প্রান্তকিকরণ ঘটায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে আদিবাসীদের গৃহহীন হওয়া, আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার সংকট ঘটা পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নয়। কেবল কাপ্তাই বাঁধের ফলেই ষাট হাজার পাহাড়ি গৃহহীন হয়েছিলেন।

কাউন্টার ইনসার্জেন্সির পরিকল্পনা অনুযায়ী জিয়াউর রহমানের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছিল। উন্নয়ন বোর্ডের রাবার বাগান প্রকল্প, কৃষিজ উৎপাদনের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কাপ্তাই বাঁধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট- সবই রাষ্ট্রের উন্নয়ন আগ্রাসনের দৃষ্টান্ত।

এই লেখার শুরুতে যেসব অনাহারী আদিবাসীর কথা আমি বলেছি- এরা সবাই উন্নয়ন আগ্রাসনের শিকার। একদিকে তাঁদের খাদ্য সংস্থানের উৎস যেমন ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে তাঁদের আদিবাসী অর্থনীতি ধ্বংস করে বাজার অর্থনীতি নির্ভর করা হয়েছে। ফলে এসব মানুষদের খাদ্যের জন্য বাজারমুখী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আদিবাসীদের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বাজার নির্ভর নয়। আদিবাসী অর্থনীতি মূলত সাবজিস্টেন্স ইকোনমি, মার্কেট ইকোনমি নয়। সমতলের একজন চাষী পটল চাষ করেন বা মূলা চাষ করেন সবটা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের জন্য। জুমচাষী পাহাড়িরা জুম চাষ করেন বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, বরং তা করেন পরিবারের ভরণপোষণের জন্য।

পাহাড়ের প্রতিটা বাজার আদিবাসীরা নয়, বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ করেন। কাঁচা বাজারের ফড়িয়া-বেপারি থেকে শুরু করে পরিবহণ পর্যন্ত। আশির দশকে যে চার লাখ সেটলার বাঙালি নিয়ে আসা হয়েছে, তাঁরা বাজার অর্থনীতির প্রতিনিধি। তাঁরা পাহাড়ে আসার সময় বাজার অর্থব্যবস্থাকে নিয়ে এসেছেন আর তাকে পাহাড়ের কোনায় কোনায় নিয়ে গেছেন।

‘‘এগ্রেসন অফ ‘ডেভেলপমেন্ট’ অ্যান্ড স্ট্রাগল ফর আইডেন্টিটি: দ্য কেস অফ ন্যাশনাল মাইনরিটিস ইন দ্য সিএইচটি, বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রবন্ধে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ উপরোক্ত পরিস্থিতির ঐতিহাসিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। আজও আমরা পাহাড়িদের উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসার কথা শুনতে পাই। উন্নয়নের মূলধারা মানে দুর্গম পাহাড়ের কোনায় পড়ে থাকা বস্তুটাকে জাতীয় বাজারের পণ্য বানিয়ে নিয়ে আসা। পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানে রাস্তা, ব্রিজের মতো উপরিকাঠামোর উন্নয়ন, বাজারব্যবস্থার চ্যানেল স্থাপন, যাতে করে সহজে পণ্য পরিচালনা সম্ভব হয়। বাজার বসলে কেউ ক্রেতা হবে, কেউ পণ্য আর কেউ বিক্রেতা। পর্যটনের ফলে যে বেচাকেনা হবে- সেখানে পাহাড়িদের সবকিছুই বিক্রি হবে। পাহাড়ি সংস্কৃতি থেকে শুরু করে যৌনতা। যেহেতু পাহাড়িদের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই, এই বাজারে পাহাড়িদের পণ্য হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। সুতরাং এই বাজার ব্যবস্থা হবে নয়া শোষণ-নিপীড়নের কৌশল। তাই এই উন্নয়ন আগ্রাসন বা ডেভেলপমেন্ট এগ্রেসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সিস্টেমেটিক মার্জিনালাইজেশন।

গোটা পর্যটনের প্রসারে পার্বত্য চট্টগ্রামটাই ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির একটা কেন্দ্র হয়ে যাচ্ছে। দুর্গম বনাঞ্চল, আদিবাসী হয়ে যাচ্ছে বেচাকেনার হাট। পর্যটকেরা ভোগ্য পণ্যের মতোই ভোগ করছে আদিবাসীদের প্রতিদিনের জীবনযাপন যেন মানব চিড়িয়াখানা!

সাংস্কৃতিক-নৈতিক-মানবিক মূল্যবোধের ত্বরিত অবক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না। ঘরের মেয়ে বাজারের মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাজারে বেচার জন্য বাগানের কাঁঠালের চাইতে নিশ্চয় নারীদেহের দাম বেশি।

লেখার শুরুতেই আমি দেখিয়েছি, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন না করে, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে, সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন যজ্ঞের সর্বাত্মক বিরোধিতা করা এখন সময়ের দাবি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের কায়েমী মহলের চক্রান্তে খাগড়াছড়িতে বিশেষ পর্যটন জোন গড়ার প্রক্রিয়া গণ-আন্দোলনের মুখে ভেস্তে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন করতে কি শুধু পর্যটনই একমাত্র উপায়? আর কিছু নয়? প্রতি বছর বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাস, বাংলায় যাকে মধু মাস বলা হয়, সেই সময়ে খাগড়াছড়ির রাস্তায় উপচে পড়া ফল পচঁতে থাকে কেবলমাত্র একটি হিমাগারের অভাবে। দরিদ্র জুমচাষী ফসলের দাম পায় না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কৃষিশিল্পের বিকাশ না করে, মানুষের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কেন পর্যটন শিল্পই বিকাশ করতে হবে? আর কোনো শিল্প কি গড়ে উঠতে পারে না সেখানে? কেন এলাকার শিল্প সম্ভাবনা যাচাই না করে হুট করে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় খাগড়াছড়িতে বিশেষ পর্যটন গড়তে গেল সরকার?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের রাষ্ট্রচরিত্র, রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি বা ‘পলিটিক্স অফ ডেভেলপমেন্ট’ নিয়ে জোর আলোচনা হওয়া দরকার। পর্যটন নামের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ দরকার। ২০১৬ সালে যেভাবে গণজোয়ার বিশেষ পর্যটন অঞ্চল রুখেছে, সেভাবে রুখে দিতে হবে উন্নয়ন আগ্রাসন।

লেখক: পাইচিংমং মারমা, ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট। 

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংয়ের কথা মনে পড়ে

ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখা

বিজু (বা বিঝু) উদযাপনে আমাদের সময় আড়ম্বর এতো হতো না। আমরা বাড়ী বাড়ী যেতাম, পাজন খেতাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে সবজি একটা আমাদের ঘরেও হতো, অনুমান করি অনেক বাঙালীর ঘরেই হয়, কিন্তু রাঙামাটিতে চাকমা পাজন যেটা আমাদের ঘরের সবজিটা ঠিক সেটার মতো নয়। একশ রকমের উদ্ভিতজাত ফল, মুল, ফুল, লতা পাতা মিশিয়ে পাজন হয়। সবার ঘরে একরকম স্বাদ হয় না। উপাদান ভেদে বা রান্নার স্টাইলের কারণে একেক রকম স্বাদ হয় একেক ঘরে, কিন্তু সুস্বাদু হয় সবার ঘরেই। বছরের এই তারিখটা, এই দিনের আবহাওয়া এই সবকিছু মিলিয়ে পাজন আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে সমীকরণ হয়, সেইটাই বৈশিষ্ট্য।

এখনকার মতো মেলা, কনসার্ট বা এইরকম অন্য কোন বিশেষ গণ-আয়োজন এগুলি হতো না। কারো কারো বাসায় পার্টির মতো হতো। আমাদের উদযাপন ছিল ঐ যে, সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, কিঞ্চিৎ পান করা এইসব। শুধু যে পাজন খেতে দিতো লোকে সেটা নয়, সাথে নানাপ্রকার সুস্বাদু খাবারও থাকতো। ভারি কোন খাবার সাধারণত পরিবেশন করা হতো না।কোন কোন বাড়ীতে ভাত হয়তো দিত সাথে, পোলাও কোরমা এইসব খাবার বিজুর সাথে যুক্ত ছিল না। পাজনের মধ্যে অনিবার্যভাবে কাঁঠাল তো থাকবেই, তীব্র স্বাদের মধ্যে কাঁচা আম থাকতো, আর করলা বা উচ্ছে এইসব। সব মিলিয়ে অমৃত।

আমি যখন রাঙামাটি কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো পর্যন্ত আমার মনে একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে যেখানেই থাকি বিজুতে অন্তত একদিন আমি যে কোন অবস্থাতেই রাঙামাটি থাকবো। পড়ে যখন বাপু বদলই হয়ে গেলেন রাঙামাটি থেকে কক্সবাজারে, পরিবাররে সবাই চলে গেলে কক্সবাজার তখন থেকে ধীরে ধীরে বিজুর সময় রাঙামাটি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিজু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে আর আমদের পরিবারে আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। নিতান্ত অনিবার্য কোন কারণ না থাকলে পহেলা বৈশাখ পুরো পরিবারের সাথে উদযাপন করতে হয়। আমার মা থাকতেও এটা ছিল, এখনো এই নিয়ম বিদ্যমান আছে।

২.

এখন তো আমার নিজেরই একটা পরিবার হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রী আর দুই কন্যার সাথে এই অধমকে মিলিয়ে। আমরা উৎসব হিসাবে দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ক্রিসমাস, ইংরেজি নববর্ষ, দুর্গা পূজা এই সবই উদযাপন করি। এই সবকিছুর মধ্যে পহেলা বৈশাখটা হচ্ছে প্রধান। দুই ঈদের বা অন্য কোন পালা পার্বণের চেয়ে পহেলা বৈশাখটা আমাদের কাছে উদযাপনের হিসাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পহেলা বৈশাখের সুবিধা হচ্ছে যে এর সাথে কোন ধর্মীয় আচার আচরণ জড়িত নাই, আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেভাবে চান সেভাবেই উৎসব বা উদযাপন সাজাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করি সব ভাইবোন ওদের বাচ্চা কাচ্চা সবাই অন্তত এক বেলা একসাথে হতে।

পহেলা বৈশাখ যদি আপনি ঢাকায় উদযাপন করতে চান তাইলে তো বিজুর সময় আর রাঙামাটি যেতে পারবেন না। এই কারণে আমার আর বিজুতে রাঙামাটি যাওয়া হয়না। জেনেছি যে এখন নাকি রাঙামাটিতে বিজু উপলক্ষে অনেক আয়োজন হয়। অনেক মেলা হয়, দোকানপাট বেসে, কনসার্ট হয়, গান বাজনা নাচের অনুষ্ঠান হয়। আমি যদি রাঙামাটি থাকতাম তাইলে সম্ভবত বিজু উপলক্ষে ছোট একটা সাহিত্য সংকলন করতে চেষ্টা করতাম। কেউ কেউ নিশ্চয় সেটা করেন, আমারই হয়তো জানা নেই। বেশী অনুষ্ঠান হতে থাকলে অনেক সময় উৎসবের মুল সুরটা ম্লান হয়ে যায়- বিজু উপলক্ষে রাঙায় এরকম হয় কিনা জানিনা।

সমানে বিজু, রাঙামাটিতে এখন নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ী সবাই বিজুর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। উদযাপনের ধরন পাল্টেছে, উৎসবের ব্যাপ্তিও বেড়েছে নিশ্চয়ই। তথাপি মুল সুরটা কখনো পাল্টায় না। চৈত্রের দাবদাহ, বছরের শেষ দিন, পাহাড়ে প্রকৃতির রূপ রঙ পরিবর্তনের সূচনা এই সব মিলিয়ে চাকমা সমাজের এই উৎসবের দিনে চাকমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের উৎসের দিকে ফিরে তাকাবেন, আত্ম পরিচয়, জাতিগত অধিকার, বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই এই সবকিছুই নিশ্চয়ই তরুণদের উৎসব উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে আছে এখনো। নিজের দিকে ফিরেও তাকাবো এবং নিজের পরিচয়েই আনন্দ করবো।

৩.  

আনন্দ তো করবই, আনন্দই মুল, কিন্তু যে আনন্দ আমার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করে না সেটা বড়ই নিম্নমানের স্থূল আনন্দ। রাঙাতে তরুণ বন্ধুরা যারা আছেন, আমি জানি এই বিজুতে আপনাদের উদযাপনের সুরেও বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের যে চলমান সংগ্রাম বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই সূরও এসে মিশে যাবে। গেংখুলির সুরে দেখবেন একটা প্রলম্বিত উদাসীন সুর অন্তর্ভুক্ত থাকে- সেই সুরটা হচ্ছে পাহাড়ের মানুষের জীবনের আনন্দের সাথে উচ্ছ্বাসের সাথে কান্নার সংযোগ। সেই কন্নাটা, সেটা মনে রাখবেন। 

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংএর কথা মনে পড়ে। কেননা আমার দেখা মতে সেই একবারই বিজু উৎসব বর্জনের কথা হয়েছিল- সেবারের বিজু ছিল কান্নার বিজু, ক্রোধ ও বেদনার বিজু। আপনি যখন এইবার বিজুতে আনন্দ করবেন, আনন্দ নিশ্চয়ই করবেন- সেটা জীবনেরই অংশ, সারা দিনের আনন্দের এক ফাঁকে অন্তত একটা মিনিটের জন্যে হলেও লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন। ভুলবেন না।

সকলেই ভাল থাকুন। আনন্দ হোক।  


লেখক: ইমতিয়াজ মাহমুদ, প্রগতিশীল লেখক ও আইনজীবী। *লেখাটি ফেইসবুক থেকে নেওয়া। 

আইডেন্টিটি ক্রাইসিস অফ গারো পিপলস

গারোদের পরিচয় বিতর্ক
                                                                  

সভ্যতার যে ক্রমর্বধমান ইতিহাস সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর যে ধারায় এই একবিংশ শতাব্দীতে চলমান রয়েছে যেখানে পুঁজির বিকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ভাষাগত আগ্রাসনের দৌড়াত্ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে করে জনসংখ্যায় তুলনামূলক কম জনগোষ্ঠীগুলোর টিকে থাকা মুশকিলে হয়ে পড়েছে।

ভৌগলিক অবস্থার বিচারে এবং বাংলাদেশের জাতিগত ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে বাংলাদেশে বহুজাতিসত্তার বিকাশ একটা দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের তথাকথিত যে বিকাশ সেই বিকাশে এই জনগোষ্ঠী গুলোর বিকাশ তো দূর বরং সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শোষণ এবং নিপীড়নে নিজের অস্তিত্ব ভুলতে শুরু করেছে বহু জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে বসবাসরত যে সকল জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের সঠিক অস্তিত্ব ভুলতে বসেছে তাদের মধ্যে একটি জনগোষ্ঠী হলো গারো জনগোষ্ঠী। যারা নিজেদের ভাষায় নিজেদের মান্দি বলে পরিচয় দিতে এক সময় পছন্দ করতো। আমরা যদি আলোচনার মূল বিষয়ের দিকে নজর দেই তাহলে সব থেকে জরুরি যে সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে সেইটি হলো, এই জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের অবস্থানগত জায়গায়।

জাতিগত পরিচয়কে অক্ষত রাখার প্রথম ধাপ হিসেবে দাঁড়ায় অনেকাংশে নিজের সংস্কৃতির চলমান ধারাকে মুক্তভাবে বইতে দেওয়া। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যখন জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে লালন করার মধ্যদিয়ে অন্য জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে তখন সেই জাতিগুলোর জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ কতটা বহমান থাকবে এবং নিজেদের আত্মপরিচয় কতটা সমুন্নত রাখতে পারবে সেইটা আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সব থেকে বড় যে সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জাতিগত সমস্যা। বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে যে সকল ভিন্ন ভিন্ন জাতিগুলো রয়েছে তাদের জাতিগত পরিচয় রাষ্ট্র কিভাবে নির্ধারণ করবে এবং এই নির্ধারনের দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের কিনা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে এই জনগোষ্ঠীগুলোকে  জাতিগত পরিচয় দিতে নারাজ। রাষ্ট্র নানা সময়ে নানান নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যেখানে দেখতে পাবেন ট্রাইবাল, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, জুম্ম, শরনার্থীর মত প্রায় ১৬টি নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতিসত্তা জাতিগত পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছে যার ফলে এই সকল জনগোষ্ঠীগুলোর জাতিগত পরিচয় আজ নানাভাবে সংকটে।

রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট জাতিগত পরিচয় নিয়ে যে টানাপোড়ন তৈরি হয়েছে এর মাঝে নতুন করে গারো জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় কি হবে সেই বিষয় নিয়ে র্দীঘদিন ধরে একটা রেশ টানার প্রক্রিয়া তৈরি হয় বিভিন্ন মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগমনে। যদিও এই আলোচনার খাতিরে এই জাতিগত পরিচয় সংক্রান্ত সমস্যায় মিশনারীদের অবস্থান নতুন বলা হলেও এর যে প্রক্রিয়া তা শুরু হয়েছে গারো জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে ধর্মীয় বিস্তারের মধ্য দিয়ে। একটি জনগোষ্ঠীর বিকাশের  ধারায় সংস্কৃতিগত পরিচয় অত্যন্ত জরুরি এবং অর্থ বহন করে। সংস্কৃতিকে বৃহৎ অর্থে ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করলে যা দেখা যাবে তা অনেকাংশে এমন শুধুমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির বিকাশ হয় না। বরং সংস্কৃতির অন্যান্য কাঠামোকে কেন্দ্র করে সেক্টরকে কেন্দ্র করে ধর্মের বিকাশের একটি জায়গা থাকে। বা বলা যায় অনান্য সেক্টর বা কাঠেমোর মত সমান্তরালভাবে সংস্কৃতিতে ধর্মের বিকাশ পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশে বসবাসরত গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশনারীদের বিকাশ বা উত্থানের ইতিহাস দেখতে যাই তাহলে একটু চোখ রাখতে হবে সাধু যোসেফ ধর্মপল্লী রানীখং এর দিকে। ইতিহাস বলছে বাংলাদেশে গারো অঞ্চলগুলোতে মিশনারীদের বিকাশের যে ধারা তার শুরু হয় অনেকটা এই ধর্মপল্লীর হাত ধরে ১৯০৯ থেকে ১৯০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। রোমান ক্যাথলিকদের এই বিকাশের আগেও ১৮৯০ শতকের দিকে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীর বিকাশ যা এখন গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন নামে পরিচিত। সুসং দুর্গাপুর অঞ্চলে গারোদের মাঝে ধর্ম বিস্তার করতে গিয়ে এই দুই মিশনারীর মধ্যে মত পার্থ্যকের  বিরোধ দেখা যায়। যার ফলে আলাদা আলাদা স্কুল কলেজ বিভিন্ন হোস্টেল এবং মিশন কেন্দ্রীক ভিন্ন ভিন্ন  প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। যার ফলে গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মীয় পরিচয়ের যে সমস্যা তার সূত্রপাতের সময়কাল আমরা ওই সময়কেই ধরতে পারি।  মোটা দাগে মিশনারীদের আগমনে গারোদের জাতিগত যে ধর্মের পরিচয় নিয়ে দ্বন্ধের সূত্রপাত বললেও পুরো লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শুধু গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারীদের বিকাশ না দেখে পুরো বিশ্বজুড়ে যে প্রক্রিয়ায় মিশনারীর বিকাশ হয়ছে সেদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মিশনারীদের বিকাশ হয়েছে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যে অঞ্চল এবং যে জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশনারীরা প্রথম এসেছে তাদের কাছে সরাসরি ধর্মের কথা নিয়ে আসেনি বরং প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে চিকিৎসালয় এবং সেই জনগোষ্ঠীর মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে প্রকৃতিকেন্দ্রীক রোগমুক্তির যে ধ্যান ধারনা তা মিথ্যা এবং ভুল। ঠিক একইভাবে মিশনারীর আওতায় বিভিন্ন স্কুল স্থাপন করা হয়েছে জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ হলেও নিজস্ব সামাজিক শিক্ষা কাঠামোর বিকাশ দেখা যায়নি।

আলোচনার বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়া এই জনগোষ্ঠীগুলোর আইডেন্টিটিতে কি প্রভাব তৈরি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কাপ্রু ম্রো পাড়ায় ম্রোদের আদিধর্ম ক্রামায় বিশ্বাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা দেখা মিলবে ৪টি থেকে ৫টি; যেখানে সদ্য বিস্তার লাভ করা খ্রিস্টীয় চার্চভূক্ত ম্রো পরিবারের সংখ্যা ৪০টির মতো। দুটো ধর্মের বিশ্বাসীরা রবিবারে নিজস্ব উপাসনালয়ে যাচ্ছে এবং যাওয়ার পথে উপসানালয়কে নির্দিষ্ট করে বলতে গিয়ে বলতে হচ্ছে ক্রামা কিঙং খ্রিস্টার কিঙং। একই সংস্কৃতিভূক্ত একই পাড়াভূক্ত একই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় হয়ে যাচ্ছে ভিন্ন। ঠিক একই বিষয় দেখা মিলবে বান্দরবানের ত্রিপুরা এবং খাগড়াছড়ির ত্রিপুরার মধ্যে। যেখানে সনাতন ধর্মের বিকাশের সাথে সাথে মিশনারীদের বিকাশ হয়েছে এবং নির্দিষ্ট পরিচয়ের জায়গা থেকে সরে এসেছে।

কিন্তু গারো জনগোষ্ঠীর প্রায় অনেকাংশে দেখা যায় মিশনারী চার্চভূক্ত। মধুপুর বন অঞ্চল ছাড়া কোথাও আদি ধর্ম সাংসারেক বিশ্বাসীদের দেখা যায় না। যার ফলে গারোদের যে বনকেন্দ্রীক বিভিন্ন মিথ রয়েছে তার চর্চা দেখা যায় না। অথচ গারোদের সংস্কৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বনকেন্দ্রীক মিথ।

মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে অবস্থিত বালপাকরাম নিয়ে মিথ

বালপাকরাম মানে আত্মার ভূমি। যেখানে গারোদের পূর্বপুরুষদের যে আত্মা সেই আত্মা মৃত্যুর পর এই পাহাড়ের গিরিপথে অবস্থান করে। বালপাকরামে আত্মার অবস্থান খুব বেশি সময়ের জন্য না, বালপাকরাম পাহাড়ের চূড়ায় যে শস্য ফলে সেই শস্য খেয়ে অন্তিম যাত্রা পথে একটু জিরিয়ে নেয় মৃত আত্মা। পূর্বপুরুষদের আত্মার আশীর্বাদেমি মিসি’, মানে জুমের ধান আরো ভালো ফলন হবে; তাই বালপাকরামের চূড়ায় ফসল রেখে দেওয়া হয় এইসব আত্মার জন্য। এতে বালপাকরাম পাহাড় ফসলে স্বয়ং সর্ম্পূণ থাকতো। যার ফলে বালপাকরাম পাহাড়ের অন্যান্য প্রাণীদের কখনো খাদ্যের অভাব হয়নি। বালপাকরামকে কেন্দ্র করে যে গারো গ্রামগুলো রয়েছে সেখানে বাস করা গারোরা মনে করে এই বালপাকরাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই কারণ এই বালপাকরামে রয়েছে পূর্বপুরুষদের আত্মার অবস্থান স্থল এবং নিজেদের মাহারি বা আত্মীয় স্বজনদের সাথে মৃত্যুর পর শেষবার মিলিত হওয়ার সুযোগ। বনকেন্দ্রীক এই মিথ গুলোর মধ্য দিয়ে হাজার বছর বনকে আকরে বাঁচার প্রক্রিয়া তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গারোরা বছরের পর বছর ধরে নিজেদের সংস্কূতির বিকাশ করেছে। 

চিৎমাং পাহাড়ের চূড়া নিয়ে গারোদের মিথ

চিৎমাং পাহাড়ের চূড়া হলো গারোদের অন্তিম আত্মার শেষ স্থল। যেখানে বালপাকরামের পর এই পাহাড়ের চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আত্মারা। চিৎমাং এর দায়িত্বে থাকেন একজন রাজা যার নাম ওয়াইমং। তিনি হলেন গারোদের সকল দেবতার গুরু। মৃত্যুর পর তিনি সকল আত্মার বিচার করবেন এবং পাপের উপর নির্ভর করে পৃথিবীতে আবার পাঠাবেন। গারোদের পাপ পূণ্য নিধারণ হবে প্রকূতিকে কে কতটা লালন করতে পেরেছে তার উপর।

বনের ভিতর ঘর তৈরি নিয়ে গারোদের মিথ

গারোদের মিথ জুড়ে স্বপ্নের একটা বিশাল ভূমিকা বা জায়গা রয়েছে। গারোরা মনে করে বন বা জমি মাটি তার শক্তি মানুষের সাথে ভাগ করে। যার জন্য নতুন বাড়ি তৈরির আগে গারোরা যখন নতুন কোনো জায়গা ঠিক করে তখন সেই জায়গার বন বা মাটিকে তাদের শক্তিকে আগে গারোদের হাতে হস্তান্তর করবে। এবং জায়গা নির্দিষ্ট করার পর আগে এই শক্তির কাছে পূজার মধ্য দিয়ে জানতে চাওয়া হয় এই জায়গা বাড়ির জন্য উপযুক্ত কিনা। পুরো ব্যাপারটা হয়ে থাকে স্বপ্নের মাধ্যমে।

বন্য পশু নিয়ে গারোদের মিথ

জাংগ্গিনি নকগিপ্পা জামানি বিয়াম্বি মানে জীবন নিঃশ্বাসের উৎস যিনি তিনি পৃথিবীর কোনো প্রাণীকে ভক্ষণ করার জন্য সৃষ্টি করেননি। প্রাণী জগতের সকল প্রাণীকে সম্মান করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেন যদি কেউ বন্য প্রাণীকে ক্ষতি না করে তাহলে দেবতা খালখামে-খালাগ্রা সকল প্রকার বন্য প্রাণীর হাত থেকে গারোদের রক্ষা করবে।

গারোদের আদিধর্ম সাংসারেকদের হাবাহুয়া বা জুম চাষের শুরু হয়মিসি সালজংকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। যেখানে মিসি সালজং হলো গারোদের সকল প্রকার ফল ফসলের সম্পদের দানকারী দেবতা। সাংসারেকরা নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় যে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে তা এই দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। প্রকৃতিকেন্দ্রীক বন, পাহাড়কেন্দ্রীক ধ্যান-ধারনা বাঁচার সংগ্রাম গারোদের আজকের না বহু বছর ধরে লালন পালন করে আসছে। যার ফলে বালপাকরাম গিরি রক্ষা, বন রক্ষা, গাছ রক্ষার মত বিষয় গারোদের সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারনে চলে আসছে দীর্ঘ বছরের মধ্য দিয়ে।

প্রকৃতিবাদী এই সাংসারেক ধর্মের অন্যান্য দেবদেবীর নাম এবং উপাস্যের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে দেখা মিলবে প্রকৃতির সাথে এই জনগোষ্ঠীর কতটা মিলন।

সাংসারেকদের বিভিন্ন দেব-দেবীর নাম

তাতারা রাবুগা - পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাণীর প্রাণের সৃষ্টিকর্তা। নস্তু-নপান্তু যাকে বলা হয় সকল প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবতা। বিশাল প্রাণের সূষ্টিতে তাতারা রাবুগাকে সাহায্যকারী দেবতা। মাচ্চি নস্তু-নপান্তুর স্ত্রী বা সৃষ্টি কাজে সাহায্যকারী দেবী।

মিসি সালজং বা সালগ্রা - সাংসারেকদেক সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের একজন। যিনি সকল প্রকার ফল ফসলের সম্পদের দানকারী দেবতা। সুসিমেমা দেবী গৃহের খাদ্য শস্য মজুদের রক্ষাকারী দেবী। রুক্ষীমেমা আহারের জন্য প্রস্তুত খাদ্যের রক্ষাকারী দেবী। কেউ কেউ শূচি বায়ূ দেবীও বলে। চুরা বুদি ক্ষেতের ফসল রক্ষাকারী দয়ালু দেবতা। গয়রা বা গোয়েরা - বজ্র বিৎদ্যুতের দেবতা। মানুষের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা খালখামে-খালাগ্রা দেবতা গয়রার ছোট ভাই। আচিক মান্দিদের বন্যপশুর আক্রমণ থেকে রক্ষাকারী দেবতা। আকস্মিক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা।

নকনি মিদ্দে-রংদিক মিদ্দে - চাউল যে পাত্রে সংরক্ষণ করে। মিসি সালজং বা সালগ্রা, সুসিমেমা রুক্ষীমেমা দেবতাদের অনুগ্রহ আশীর্বাদ ছাড়া মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই একে তিন দেবতার হাত বলে। সুসুমি দেবী- বিদ্যা, বুদ্ধি কূটনীতির ধারক বাহক। আচ্চু আম্বীদের মুখে শোনা এই সুসুমি দেবী, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব, বোবা, কালা প্রভৃতি জরা ব্যাধির কারণ। পৌরাণিক কাহিনীতে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য তাতারা রাবুগা এই দেবী সুসুমির পরামর্শ গ্রহণ করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর নিজেদের সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টির জন্যও এই দেবীর পরামর্শক্রমে সকল দেবতাদের কাছে ডাকেন সৃষ্টিকর্তা তাতারা রাবুগা। পরে মানুষ সৃষ্টির পর পৃথিবীতে মানুষের বাস উপযোগী স্থান নির্ধারণের জন্য দেবী সুসুমিকেই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। আচিক মান্দিদের সব ধরণের বিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্যও এই দেবী সুসুমিকেই আবার পৃথিবীতৈ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নাওয়াং : মৃত ব্যক্তিদের আত্মাদের পরপারের রাস্তার পাহারাদার। কথিত আছে, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা নাওয়াংকে পয়সা, টাকা না দিলে রাস্তা পার হওয়া যায় না। তাই আচিক মান্দিরা মৃত ব্যক্তির হাতে টাকা গুজে দেয়। আসিমা-দিংসিমা : সুসুমি দেবীর মা। পৃথিবীর শান্তি রক্ষাকারী দেবী। কোন প্রকার প্রাণীর বলি সে পছন্দ করে না। তার জন্য কোন ফল উৎসর্গ করলেই সে পরিবারে, গ্রামে শান্তি প্রদান করে। টংরেংমা : ব্যক্তিকে সাহস দানকারী গৃহে শান্তি রক্ষাকারী দেবী। আল্লেমী - সব দেবীদের রাণী। মেগাপাফিয়া - শিশুদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষাকারী দেবী। চু রাশি - শিশুদের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা। আন্নিং - শিশুদের মাতৃগর্ভ থেকে বোবা, কালা, অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষাকারী দেবী। চাগব - শিশুদের শয়তানের কু নজর থেকে রক্ষাকারী দেবতা। চি গিচ্ছাক - বাত রোগের আরোগ্যকারী দেবতা। ওয়াল গাথ - যুদ্ধে আঘাতের ব্যথার আরোগ্যকারী দেবতা  জগু - ফুসফুসের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। সাল বামন - মাথা ব্যথা চোখের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। উদুম মিদ্দে - পেটের পীড়ার আরোগ্যকারী দেবতা। নচীডু-মারুচাং - পাতাল পুরীর রাজা দেবতা। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস থেকে মানুষকে রক্ষাকারী। চিরিং চিমিট - পাতাল রাজার স্ত্রী দেবী। পাহাড়ের ঝর্ণার জল দানকারী দেবী।রমনজার - জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়। ডিনজার - জীবন্ত ছোট পাথর। মানুষ সৃষ্টির জন্য অন্য গ্রহের মাটি পিঠে বহণ করে আনাতে সেও পাথর হয়ে যায়। নরে চিরে, কিমরে বকরে : বৃষ্টির দেবী। বোন জাসকো - অরণ্য দেবতা। বনের সমুদয় প্রাণীর রক্ষাকারী দেবতা। গান্দো - অরণ্য দেবী। বোন জাসকের স্ত্রী। দারিচিক মিদ্দে - মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরিকারী স্ত্রী লোকের যৌন রোগের আরোগ্যকারী দেবী। রুরুবে খিন্নাসে - মানুষের নারী ভুরী, ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনী তৈরিকারী এইসব রোগের আরোগ্যকারী দেবী। জারুমে আজাবাল : বায়ু দেবতা। মিকখা টেম্মা স্টিল রংমা - ঘূর্ণি ঝড়ের দেবতা। মিসি আপিলফা - মাটির উর্বরতার দেবতা। সালজং গালাফা - ধান ক্ষেতের পাহারাদারের রক্ষক। দিম্মেং কককেং - নব দম্পতিদের আশীর্বাদ দানকারী। দিম্মেং - আদম কককেং - হবা। তোয়ারা নাংগাপা - মুর্ছা যাওয়া থেকে রক্ষাকারী। বিদাউই মিদ্দে - সূতিকা রোগের আরোগ্যকারী দেবী।

বাংলাদেশে মিশনারীদের আগমনের পরবর্তী সময়ে গারোদের হাজার বছর ধরে লালিত প্রকূতিকেন্দ্রীক যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাস থেকে সরে এসে চার্চকে কেন্দ্র করে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই আগ্রহ তৈরির সাথে সাথে নিজস্ব চিন্তার জায়গা থেকে শুরু করে নিজস্ব খাদ্যাভাস থেকেও অনেক দূরে অবস্থান করছে গারো জনগোষ্ঠী। বনকে কেন্দ্র করে খাদ্য সংগ্রহের যে ধারনা, বনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার যে তাগিদ, সেই তাগিদ সাংসারেক বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বিলীনের পথে। আব্রাহামিক ধর্মের চর্চায় সকল সৃষ্টির মালিক স্রষ্টা এবং স্রষ্টাই শেষ কথা। যার ফলে সৃষ্টির অন্যান্য প্রাণের সম্ভারকে বাইপাস করে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার যে প্রক্রিয়া তা চলমান রয়েছে। একেশ্বরবাদী ধ্যান ধারণায় গারোদের বন পাহাড় কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া দেব-দেবীর ধারণা খারিজ হয় এবং ইতিহাসের পাতায় স্থান হয় বিভিন্ন প্রেতাত্মার নামে। 

গারোদের নিজস্ব গান্দাবারা রীতি ভেঙে পুঁজির সাথে পরিচয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক রীতি চালু আছে যেখানে দেখা যায় সাময়িকভাবে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার কৃষি কাজের জন্য অকুলান হয়, তখন একজন ব্যক্তি বা এক পরিবারের শ্রম ধার দেওয়া হয়। বৃদ্ধ বা অক্ষম লোক রয়েছে এমন পরিবারকে সামর্থ্যবান বয়স্ক নর-নারী তাদের একদিনের শ্রম দান করে। রোগী, গর্ভবতী স্ত্রীলোক এবং সন্তান প্রসবের পর নতুন মাকে খাদ্য প্রদান করে। এই রীতিকেমালেইয়ারীতি বলা যায়। যা মূলত জুম চাষের উপর নির্ভর সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়।  

একই ধারার প্রচলন গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত; যাকে বলা হয়গান্দাবারা এই গান্দাবারা রীতিতে পুরো গ্রামের লোক এক এক করে সবার জমির ফসল কেটে দেওয়ার কাজ করে বিনা পারিশ্রমিকে। যে বাড়ির ফসল কাটা হয় সেই বাড়িতে কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় সবাই মিলে আহার গ্রহণ করে। কিন্তু সাংসারেক ধর্মের বিলুপ্তি এবং আব্রাহামিক ধর্মের বিকাশ বা মিশনারীদের উত্থানের ফলে মার্ক্সীয় তত্ত্ব মতে পুঁজির বিকাশ এবং পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে শ্রম মজুরির অসম বন্টন সূত্রপাত হয় এই জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে।

মিশনারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য বৃহৎ পুঁজির সাথে এই জনগোষ্ঠীর পরিচয় এবং দানবাক্স নামক তত্ত্বের উদ্ভব আস্তে আস্তে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অর্থনৈতিক বা বিনিময় কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে। ধর্মীয় ধ্যানকে সামনে রেখে শ্রম এবং মজুরির অসম বিকাশ পুরো কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করে।

বিশুদ্ধতার প্রশ্নে সাংসারেক

সাংসারেক কামালদের কাছে লোকগল্প আকারে শোনা যায় এক দম্পতি যারা মধুপুরের বনকে কেন্দ্র করে বাস এবং সাংসারেক ধর্মে বিশ্বাস করতো। কিন্তু দম্পতির স্ত্রী খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ার পর সংসার ত্যাগ করে নিরুদেশ গমন করেন। জাতির বিশুদ্ধতা, সংস্কৃতির বিশুদ্ধতায় আন্তঃধর্মীয় বিবাহ বা আন্তঃসংস্কৃতি মিশ্রনের একটি ভয় চেপে ধরতে শুরু করে গারো জনগোষ্ঠীকে।

গারো জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের নিজস্ব জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার রক্ষনশীল প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যায় সাংসারেক বিলুপ্তির পর। গারো জনগোষ্ঠীর বাইরে সাংসারেক বিশ্বাস যেমন অন্য জনগোষ্ঠীরা করে না. তেমনি অন্যান্য জাতিসত্তা যাদের পুরো সংস্কৃতি কাঠামো গারো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কাঠামোর বিপরীতে তাদের সাথে একীভূত হওয়া এবং হয়ে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা তৈরি হয় ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে। যার ফলে পিউর ব্লাড বলে যে থিউরি এক সময় প্রচলন ছিলো তার পরিবর্তন হয়। নিজেকে গারো বলে পরিচয় দেওয়ার বাইরে নিজেকে খ্রিষ্টিয়ান বলে পরিচয় দেওয়ার প্রবল আর্কষণ বৃদ্ধি পায়। মিশনারীদের আগ্রাসনমুখী ধর্মের বিকাশের সাথে একই ধর্মেরভূক্ত করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে জাতিগত পরিচয়ের উর্ধ্বে নেওয়ার পূথিবীব্যাপী  চেষ্টায় গারো জনগোষ্ঠী সামিল হয়। এবং পুরা প্রক্রিয়া গারো জনগোষ্ঠীকে যেভাবে চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে এতে রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন নামে বেনামে পরিচয় এবং একই সাথে নিজস্ব ধ্যান ধারণা চিন্তার বাইরে ধর্মীয় পরিচয় পুরো জনগোষ্ঠীর আইডেন্টিটির মাঝে তৈরি করেছে সংকট। গারোরা আসলেও গারো নাকি উপজাতি নাকি খ্রিস্টিয়ান।

লেখক: প্রত্যয় নাফাক, সাবেক সভাপতি ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদ। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho