প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক আচরণের নিন্দা ও তদন্ত দাবি

প্রীতি ওরাং

ঢাকার মোহাম্মদপুরে আদিবাসী কিশোরী প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক আচরণের নিন্দা ও ঘটনার দ্রুত তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো ১১৭ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সই করা ওই যৌথ বিবৃবিতে বলা হয়, প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ডের নামান্তর বলে আমরা মনে করি। কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হলে আমরা তা মেনে নেব না।

এ ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং কয়েকটি গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক আচরণের বিষয়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় বিশিষ্ট নাগরিকেরা। সেই সঙ্গে ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক গুরুতর অপরাধ বিশেষত কন্যা শিশুকে কাজে নিয়োগ করা এবং নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিবৃতি বলা হয়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহম্মদপুরে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ১৩ বছর বয়সী শিশু প্রীতি উরাং কর্মরত ছিল। অভিযোগ রয়েছে আশফাকুল হকের স্ত্রী তানিয়া হক প্রায়ই তার বাসায় কর্মরত গৃহকর্মীদের মারধর করতেন। সর্বশেষ প্রীতিকে আট তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

প্রীতির বাবা অভিযোগ করেছেন, ওই গৃহে কাজ করার সময় সৈয়দ আশফাকুল হকের পরিবার প্রীতিকে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিত না। শিশুটি পড়ে যাবার আগে প্রায় ১৩ মিনিট ঝুলে ছিল এবং বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু আশফাকুল হকের বাসা থেকে কেউ তাকে সাহায্য করেনি। আশ-পাশের মানুষজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে চাইলেও ওই বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। ‍

শিশুটি পড়ে যাওয়ার পরে ওই বাড়ির কেয়ারকেটার তাকে হাসপাতালে ফেলে চলে আসে। পরে সে মারা যায়। লক্ষ্যণীয় হলো, প্রীতির প্রাক-স্কুলের নথি এবং ওই ফ্ল্যাটের ওই সময়ের সিসি টিভি ফুটেজ দুটোই গায়েব হয়ে গেছে। এটাও লক্ষ্যণীয়, এজাহারে প্রীতির বয়স ১৩ বছরের বদলে ১৫ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রীতির মৃত্যুর ১০ দিন পর ডেইলি স্টারের সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন, প্রীতির ঘটনায় তারা দুঃখ প্রকাশ করছে এবং ডেইলি স্টার সবসময় শিশু অধিকার সমুন্নত রাখার নীতিতে অটল আছে।

বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে আটটি দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো- ক) প্রীতি উরাংসহ পূর্বের সব ঘটনার পুনঃতদন্ত করে দ্রুত দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

খ) প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা না করে এ মামলা অবিলম্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

গ) প্রীতির পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। সেই সাথে তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

ঘ) মৃতবৎ অবস্থায় যে শিশুটি বেঁচে আছে তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

ঙ) শিশুটির শরীরের বিশেষ ক্ষতটি পরীক্ষা করে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করতে হবে।

চ) সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ৩ জন শিশু গৃহসহকারী ছিল। তারা ৭, ৮ এবং ১১ বছর বয়সে কাজে যোগ দেয়। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তি শিশু। শ্রম আইনের ৩৪ ধারা অনুয়ায়ী, কোন শিশুকে কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। আশফাকুল হক কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য শিশু যৌন নিপীড়ক কিনা সে বিষয়ে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি আমরা।

ছ) যে দারোয়ানরা প্রীতিকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে দেয়নি, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

জ) ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অপরাধ বিশেষত কন্যা শিশুকে কাজে নিয়োগ করা এবং নির্যাতন করার অভিযোগে তাকে অবিলম্বে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধাপক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না রয়েছেন বিবৃতিদাতাদের মধ্যে।

আরো রয়েছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক মানস চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কণা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, গীতি আরা নাসরিন, দিপ্তী দত্ত, খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, লেখক ও গবেষক প্রিসিলা রাজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল, লেখক রেহনুমা আহমেদ, সাংবাদিক সাঈদিয়া গুলরুখ, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন।

এছাড়াও জনউদ্যোগের আহ্বায়ক ডা. মুশতাক হোসেন, সংগীত শিল্পী ফারাজানা ওয়াহিদ সায়ান, রাঙামাটির চাকমা রানী য়েন য়েন, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তির্কী, শিল্পী মুনেম ওয়াসিফ, লেখক ও অনুবাদক ওমর তারেক চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ প্রমুখ। 

কোন মন্তব্য নেই

© all rights reserved - Janajatir Kantho