অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—গারো জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ওয়ানগালা আয়োজনের মৌসুম। কৃষিবর্ষ চক্রের এই সময়ে শস্য দেবতা মিসি সালজং–এর সম্মানার্থে সাংসারেক অনুসারীরা ওয়ানগালা উৎসব করে থাকে। বর্তমানে গারোদের প্রায় নব্বই শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী হলেও গারো সংস্কৃতিজনেরা সাধারণভাবে সামাজিকতা আদি সংস্কৃতি চর্চার প্রবণতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ওয়ানগালা আয়োজন করে।
যার প্রেক্ষিতে ঝিমিয়ে পড়া গারো সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ও শেকড়ের সাথে নতুন প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটাতে সম্প্রতি (১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর) ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করে থকবিরিম। টাঙ্গাইল মধুপুরের শালবন পরিবেষ্টিত চুনিয়া বনানী আচিক (গারো সাংস্কৃতিক) ক্লাব মাঠে ঘরোয়া পরিবেশে এই ওয়ানগালা হয়। তিনদিনব্যাপী আয়োজিত এই উৎসবে চুনিয়া ছাড়াও আশেপাশের পীরগাছা, জয়নাগাছা, নয়নপুর, সাইনামারী প্রভৃতি গ্রামের গারো জনগোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকেও সংস্কৃতিজনেরা উৎসবে সামিল হন।
আয়োজক কমিটির প্রধান কবি ও লেখক মিঠুন রাকসাম। আয়োজন সম্পর্কে জনজাতির কন্ঠকে তিনি বলেন, ‘এই ওয়ানগালা আয়োজনে আদি রীতির ফ্লেবার দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা কোন ধরণের সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার কিংবা আলাদা মঞ্চের ব্যবস্থা করিনি। বরং আচিক ফা’গিচ্চামদের মত অঙ্গারি তৈরী করে সেটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।’
ওয়ানগালা আয়োজনে গারোদের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিজনদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। বিষয়টি নিয়ে কবি মিঠুন রাকসাম বলেন, ‘স্বরণকালের ইতিহাসে ওয়ানগালা উৎসবে এমন সংখ্যক ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকজন (বাঙালি) অংশগ্রহণ করেনি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কায়সার মুহাম্মদ মঈনুল হাসান, বাংলা একাডেমির পরিচালক সরকার আমিন, সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী, নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন, গবেষক পাভেল পার্থ ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর, নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক শিক্ষক সহ তরুণ কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের প্রায় ৫০-৬০ জন উপস্থিত ছিলেন। যারা দারুণ ওয়ানগালা উপভোগ করেছেন।’
তিনদিনব্যাপী ওয়ানগালা আয়োজনে যা যা ছিল
উৎসবে আজিয়া, রে রে, দামা দক্কা, আদুরি শিক্কা, চাম্বিল মেশা, গ্রিকা, সেরা চু মান্থি প্রতিযোগিতার আয়োজন নতুন মাত্রা যুক্ত করে। পার্শ্ববর্তী নয়নপুর গ্রাম থেকে বিচিত্রা ম্রং এর সেরেজিং টিম, সাইনামারির আজিয়া শিল্পীরা অংশ নেন। গারো নারীদের পাশাপাশি বাঙালি নারীরাও রাং, আদুরি, দামার সম্মিলিত দিমচেং দিমচেং তালে নৃত্যে মেতে উঠেন; ক্যামেরায় ধরা পড়েন মোহিনী রূপে।
![]() |
| চুনিয়া ওয়ানগালায় ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তরুণীদের নৃত্য। ছবি: ফেইসবুক |
এছাড়াও গারো বীর উৎপল নকরেককে বিশেষ সম্মাননা ও মধুপুর ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে শহীদ পীরেন স্নালকে দেওয়া হয় মরণোত্তর সম্মাননা। সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রাখায় দুইজন মহীয়সী নারীকে থকবিরিমের তরফ থেকে দেওয়া হয় সম্মাননা। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন— কইয়নী মৃ ও মোনালিসা সাংমা।
আগামীতেও এ ধরণের ওয়ানগালা আয়োজন করা হবে কিনা জানতে চাইলে কবি মিঠুন রাকসাম জানান—এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। চুনিয়াবাসী সহ আমরা সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিবো। তবে এবারের ওয়ানগালা আয়োজনে চুনিয়াবাসী সহ আশেপাশের গ্রামের লোকজন যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তা এক কথায় অভূতপূর্ব। তাদের সবার সহযোগিতায় ওয়ানগালা আয়োজন সফল হয়েছে।
থকবিরিমের ওয়ানগালা কেন এত আলোচনায়
চুনিয়া ওয়ানগালায় ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মানুসারী মানুষদের অংশগ্রহণ যেমন বৈচিত্র্যের দিককে সামনে এনেছে তেমনি তাদের দকমান্দা দকশাড়ি পরিহিতা ছবি নৃত্যগীত সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষত সাংসারেক কমিউনিটির মাঝে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাদের কেউ কেউ বলছেন, বাইরের লোকেদের এনে, তাদের অর্থায়নে ওয়ানগালা উদযাপন উৎসবের প্রকৃত বার্তা বা উদ্দেশ্যেকে ম্রীয়মান করে তুলেছে।
বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন সাংসারেক শীতল স্নাল। তিনি জনজাতির কণ্ঠকে বলেন, ‘থকবিরিমের এই ওয়ান্না নিঃসন্দেহে হাইব্রিড ওয়ানগালা। এটি পৃষ্ঠপোষকদের মনোরঞ্জনের এবং তাদের দেওয়া অর্থ হালাল করার জন্য এই ওয়ান্নার আয়োজন করা হয়েছে। এখানে মান্দি জনজীবনের যে আদিমতা উঠে আসার কথা ছিল তা উঠে আসেনি। থকবিরিমের ওয়ান্না দেখে মনে হল মঞ্চে কোন নাটক দেখছি এক কথায় ওয়ান্নাকে মঞ্চস্থ করা হয়েছে।’
![]() |
| সাংসারেক শীতল স্নাল। ছবি: সংগৃহীত |
চুনিয়ার ওয়ান্নাতে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘ওয়ানগালার মাধ্যমে ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করতে বা ওয়ানগালাকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না; যেহেতু এটা সাংসারেকদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু চুনিয়ার ওয়ান্নাতে এটা স্পষ্ট যে, ওয়ান্নাকে পর্যটন এবং বাণিজ্যিকীকরণের হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে। আপনারা এটাও দেখতে পেয়েছেন যে এখানে কিছু অসুস্থ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল।’
চুনিয়া গ্রামের যুবক শাওন রুগা বলেন, ‘আমি যদি খ্রিস্টান হই, আমি যেমন হিন্দু-সনাতনীদের পূজা আয়োজন করে উদযাপন করতে পারি না, ঠিক তেমনই সাংসারেক ধর্মাবলম্বীদের ওয়ান্নাও জাতিগত সংস্কৃতি রক্ষা ও বিস্তারের নামে আয়োজন করে উদযাপন করতে পারি না। যদি করি, তা হবে ধর্মীয় শিষ্টাচার পরিপন্থী বা আইনত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সমতুল্য অপরাধ।’



কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন