পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব


কার্ল মার্কস প্রথম বিচ্ছিনতা (alienation) প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। মার্কসের মতে এই বিচ্ছিন্নতা হল এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যা একজন মানুষকে একটি অর্থপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন, সামাজিক ব্যবস্থা, সংগঠন, নিজের শ্রমের সাথে একাত্ম হতে পারে না তখন সে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করে। এভাবে বোঝা আরো সহজ, যখন আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র জনগণের সঙ্গে আধিপত্যের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে তখন জনগণের মধ্যে বিচ্ছিনতাবোধের জন্ম হয়। এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের সাথে জনগণের সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও মার্কস শ্রমিক শ্রেণিকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর তত্ত্বকে উপযোগী করেছেন। কিন্তু এ বিচ্ছিনতার ধারণা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং বড় সংকটও বটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এই বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বকে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ব্যয়বহুল সামরিক শাসন জারি রেখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য কায়েম করার সর্বোচ্চ চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চলে একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখা হয়েছে অন্যদিকে উন্নয়নের নামে স্থানীয়দের সংস্কৃতি, ভূমি, জীবন-জীবিকার উপর আগ্রাসন চলছে।

ধরেন, পুঁজিবাদী সমাজে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হলো কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের নিপীড়িত, বঞ্চিত জনগণ, শ্রমিক-কৃষকের ভাগ্যের কি কোনো বড় পরিবর্তন হবে? শ্রমিক-কৃষকের ছেলে মেয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সক্ষম নয়। এবং শ্রমিক-কৃষকের সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অবস্থা এই বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা ও কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ব্যতিক্রমী উদাহরণও আছে নিশ্চয়্ই যেখানে শ্রমিক-কৃষকের ছেলেমেয়ে মেধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়।

নিংসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ও একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের মানুষের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। কিন্তু সমাজে যদি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার শর্তগুলো তৈরি না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে কতটুকু অবদান রাখতে পারে সেখানে বড় সন্দেহ থেকে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষেত্রেও একথা সর্বাংশে সত্য। বাংলায় প্রবাদ আছে যে, ‘‘বেল পাকলে কাকের কি লাভ?’’ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হারে পর্যটন, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হচ্ছে তাতে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের কি লাভ? পাহাড়িদের ঘরের উঠোনে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে অথচ পাহাড়ের সন্তানরা প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরুতে পারছে না ।

২০১২ সালে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে অর্থাৎ ৫ম শ্রেণীতে উঠে প্রায় ৫৯ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে যা কিনা সারা দেশের গড় হারের পুরো দ্বিগুণ।’’ এবং ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রথম আলো পত্রিকায় উঠে আসে ‘৭৫০ শিক্ষার্থীর মাত্র দুজন শিক্ষক।’ যা কিনা রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার একমাত্র সরকারি স্কুল ।

এই বছরের শুরুর দিকে ‘কলেজটি নামে মাত্র স্নাতকোত্তর’ শিরোনামে প্রথম আলোয় উঠে আসে।কলেজটি বান্দরবান সরকারি কলেজ। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এই কলেজের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক থাকার কথা ৯০ জন। অথচ জাতীয়করণের পর থেকে উচ্চমাধ্যমিকের জনবল নিয়েই চলছে কলেজটি। বর্তমানে মাত্র ৩২ জন শিক্ষক দিয়েই চলছে পাঠদান।’

গত ৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হারের এই পরিসংখ্যান দেখুন—

পাশের সন     খাগড়াছড়ি (পাশের হার)      রাঙামাটি            বান্দরবান

২০১৯         ৪৯.৯৩%                   ৪৫.৫০%            ৫৯.৭১%

২০১৮         ৩৬.৬১%                   ৪৫.৯৯%            ৬২.৩১%   

২০১৭         ৪৪.৬৩%                   ৪৫.৮৯%            ৫৫.২২%

এই হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার করুণ অবস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাইমারি-মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন না করে, পাহাড়ি সমাজের উপযোগীতা বিচার ও মতামত না নিয়ে আপনি হুর হুর করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে যাবেন কেন? এটা তো রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কান্ডজ্ঞানহীনতা অথবা সবকিছু জেনেও নির্লজ্জের মত অস্বাভাবিকতা।

এই মাসে (অক্টোবর  ২০২০) কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা বিভাগ খোলা হয়েছে। এর আগেও বিদ্যাসাগর, বর্ধমান ও পুরুলিয়ার সিধু কানহু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা নিয়ে পড়ানো হত। এ বছর থেকে যাদবপুরে সাঁওতাল ভাষায় পড়ানো শুরু হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বৈচিত্র‌্যপূর্ণ জাতিসত্তাসমূহের ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য জন্য আলাদা বিভাগ ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট খুলতে পারতো। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জায়গা দখল করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রতিযোগিতার প্রয়োজন পড়তো না।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করে। এই শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষা ব্যবস্থা সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে তিন সার্কেলের প্রধান তিন রাজা, রাজাদের অধীনস্থ তিন হেডম্যানকে ও রাখা হয়। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মিডল ইংলিশ স্কুল ও ইংরেজী হাই স্কুল স্থাপন করে। এসব স্কুলে প্রাথমিক ভাবে বাংলা ও ইংরেজীর পাশাপাশি চাকমা ও মারমা ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলন রাখা হয় এবং সীমিত সংখ্যক আসনের হলেও দূরদূরান্ত থেকে আগত পাহাড়ী ছাত্রদের জন্য নিরখরচায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বর্তমান সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পিছিয়ে পড়া জাতিসত্তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন। এছাড়া জাতিসত্তাসমূহের ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ‘জাতিসত্তাসমূহের ভাষা একাডেমী’ও সময়োপযোগী দাবী। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাই বরাবরই এসব বিষয়ে কর্ণপাত করেনি এবং যতটা সম্ভব উদাসীন থেকেছে।

আদিবাসী জনগণের দাবির মুখে ২০১৭ সাল থেকে ৫ টি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বই বিতরণ ও কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলেও এখনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাজ প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বান্দরবান জেলা পরিষদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে ২৫% বিনিয়োগ করেছে এবং সম্প্রতি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করেছে। রাঙামাটির সাজেকেও জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্থানীয় জনগণের স্কুলের চাহিদাকে উপেক্ষা করে মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ আইন অনুযায়ী তাঁদের কাজ ছিল শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢেলে সাজানো ও মজবুত করা। বর্তমানে এই অনির্বাচিত ক্ষমতাসীন দলের জেলা পরিষদ এখন দুর্নীতির আকড়ায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পাহাড়ি জনগণ ক্ষোভে এর নাম দিয়েছে ‘জ্বালা পরিষদ’। সারাদেশে ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় অথচ এগুলো ২২ বছর ধরে অনির্বাচিত। একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক কিংবা পরিষদের অন্যান্য বিভাগের চাকরির জন্য পরিষদের সদস্যদের বাধ্য হয়ে ঘুষ দিতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। বিভিন্ন মিডিয়া মারফতে এসব দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন, পর্যটন, বিশ্ববিদ্যালয় হলে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করা হয়। ইতিমধ্যে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য পাহাড়ি অধ্যুষিত ঝগড়াবিল মৌজার  ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং স্থানীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ ও শেষ পর্যায়ে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বহিরাগতদের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। একজন পাহাড়ির ঘরের উঠোনে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে অথচ তাঁর কোনো স্বার্থ নেই, সম্পৃক্ততা নেই, অনুভূতি নেই। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তাঁর ভিটেমাটিও কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তাঁকে প্রান্তিকতার শেষ সীমানায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ি জনগণের জন্য এর থেকে বড় বিচ্ছিন্নতা আর কি হতে পারে?

রাষ্ট্র যদি ক্রমাগত এই বিচ্ছিন্নতাকে ধরে এগোতে চায় তাহলে বলবো তাঁরা ভুল পথে হাঁটছে। পাকিস্তান ভেঙে দু’টুকরো হওয়ার ইতিহাস যেন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা ভুলে না যায়। কারণ পাহাড়ি জনগণের এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। রাষ্ট্র ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার পথে হাটবে আর পাহাড়িরা হাটবে শান্তি-সম্প্রীতি উন্নয়নের পথে। কি চমৎকার চাটুকারিতা! সভ্য সমাজে কথা দিয়ে কথা না রাখা, বিশ্বাসঘাতকতা করা,  চাটুকারিতা করা বেমানান ।

দীর্ঘ পাঁচ দশক পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তি-সম্প্রীতি উন্নয়নের আশ্বাসে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আর নয়।


লেখক: রোনাল চাকমা, ছাত্রনেতা। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho