আদিবাসী কে?

আদিবাসী কে?
-লেখক

আদিবাসী হতে হলে আদি বাসের রীতি জানতে হবে। মানতেও হবে। এই রীতিটা কি? রীতিটা সহজ বনের সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, পাহাড়ের সঙ্গে থাকবার অভ্যাস। পাহাড় আপনার আহার জোগাবে, বসবাসের জায়গা দেবে, কিন্তু আপনি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানাবেন না। বনকে আপনার মনমতো বাগান বানাতে যাবেন না, যেমন করা হচ্ছে, মধুপুরের শালবনে অ্যাকাশিয়া রোপন করে। নদীর মৃত্যু হয়, নদী মরে যায়, গতিপথ বদলায়, জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়— এই সবই প্রকৃতির নিয়মে হতে পারে। তাই বলে আপনি-আমি তো নদীর মৃত্যুর কারণ হতে পারি না। নদী কাঁদে, নদীর কান্না শোনার মতো সংবেদনশীলতা থাকতে হবে।

আদিবাসী কে? সে প্রশ্নের উত্তরে কথা বলতে গিয়ে আমাদের এক বন্ধু এই রকমই কিছু কথা বলছিলেন। আদি বাসের রীতি নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যাটা সুন্দর। তার মনপছন্দ এই ব্যাখ্যা নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা হয়তো মানবেন, হয়তো মানবেন না। আমার কাছে বেশ কিছুদিন ধরে যাঁরা আদিবাসী বলতে আমি কি বুঝি জানতে চেয়েছেন, তাঁদেরও হয়তো আদি বাসের এই রীতিনীতির ব্যাখ্যা দিয়ে খুশি করা যাবে না।

দু’দিন আগে আমার শিক্ষকতুল্য এক সহকর্মী ‘উপজাতি অঞ্চলে’ যেতে চাইলেন? আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘উপজাতি মানে কি স্যার উপনদীর মতো কিছু? কোন্ জাতির উপজাতি কে?’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি অত সংজ্ঞা জানি না।’ আমি ওই শিক্ষককে অনুরোধ করেছি, ‘স্যার, আমরা ভুল শিখেছি বলে আমার ধারণা। কিন্তু, আপনি তো শিক্ষক। আপনি একবার ভাবেন না। কোনো জাতি কি অন্য কোনো জাতির উপ হয়?’ বাংলাদেশের আদিবাসীরা ‘উপজাতি’ শব্দটি পছন্দ করছিলেন না, এখন আমরা ওই শব্দ বিতাড়নের নামে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ জাতীয় যে সব শব্দ ব্যবহার করছি, তা আদিবাসীদের জন্য আরো বেশি বেদনাদায়ক হয়েছে।

আমরা যদি বসতি স্থাপনের ইতিহাস ধরে জানতে চাই বাংলার আদিবাসী কারা, তাহলেও এটা নিশ্চিত যে এই অঞ্চলের আদিবাসী বাঙালি নয়। জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাস নেহায়েত কম দিনের নয়, তবে তারও আগে অনেক জাতি বর্তমানকালের বাংলায় বাস করত। বাঙালি একটি সংকর জাতি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীগুলোর একটি। অন্তত দেড় হাজার বছর আগে আর্য-অনার্য মিশ্রিত প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে এবং ব্রাহ্মী লিপি থেকে সিদ্ধম লিপি হয়ে বাংলা লিপির সৃষ্টি। এর আগে-পরে অস্ট্রিক ও নিগ্রিটো জাতির মানুষসহ বহু জাতির রক্ত এসে মিশেছে বাঙালির সঙ্গে। তাই বাঙালিদের কেউ একটু বেশি লম্বা, কেউ মাঝারি, কেউ আবার বেঁটে। কারও গায়ের রং খুব ফরসা, কেউ শ্যামবর্ণ, কেউ বা কালো। কারও নাক খাড়া, কারও অতটা নয়। মাথার চুল কারও সোজা, কারও অল্প বা বেশি কোঁকড়ানো।

বাঙালির জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের সঙ্গে আর্য-অনার্যের লড়াই জড়িয়ে আছে। আর্যদের আদিবাস ছিল উত্তর ইরানে, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। আর্যরা এসে দ্রাবিড়দের অধিকার করে নিল। দ্রাবিড় কারা? আর্য আগমনের অনেক আগে থেকে বাংলায় যে আদি মানুষের অস্তিত্ব ছিল তাদের দ্রাবিড় বলা হয়, নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এরাই অস্ট্রিক বা অস্ট্রোলয়েড গোত্রের মানুষ, আরো সহজ করে বললে বলা যায় কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি। এই জাতিগুলো শুধু বাংলার নয়, গোটা ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা। বাংলাদেশে এখনো সাঁওতালরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা রয়েছে। ভারতে আসার পর আর্যরা ঠিকই বাংলায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। উর্বর ভূমির সন্ধানে খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছর আগে উত্তর ভারতে আসে আর্যরা। ভারতবর্ষের সবচেয়ে উর্বর জমির অঞ্চল বাংলাকে আর্যরা দখল করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেকালে বাংলায় বসবাসকারী কোল, ভীল, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতির লড়াকু মানুষগুলো প্রতিরোধ তৈরি করেছে। ফলে অহংকারী আর্যরা বারবার পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

আর্য অহঙ্কার, আর্যদের জাতিগত উদ্ধত্যের কথা নৃতত্ত্ববিদ এ কে এম শাহনাওয়াজের ছোটদের জন্য একটি লেখায় খুব সুন্দরভাবে এসেছে, ‘নিজেদের লেখা বেদ গ্রন্থে তারা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছে। অন্যের দেশ দখল করেছে—এ নিয়ে পরে যদি কথা ওঠে, তাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য গল্প ফেঁদেছে। এমনিতে আর্যরা নিজেদের খুব উঁচু জাতের মনে করত। তারা দেখতে ছিল সুন্দর। আগুনের পূজা করত তারা। সে যুগে অগ্নি উপাসকদের সেরা জাতের মনে করা হতো। এই নাক উঁচু আর্যরা লিখেছে, ভারত অপবিত্র দেশ। এখানে বর্বর মানুষেরা বাস করে। আর্যরা অমন দেশে থাকতে পারে না। তবে তাদের একটি সুবিধা ছিল। বিদেঘ নামে একজন মুনি বা পুরোহিত ছিলেন। তাঁর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। বিদেঘের মুখ দিয়ে আগুন বের হতো। তিনি হেঁটে যেতেন আর মুখের আগুনে চারপাশ পুড়িয়ে খাঁটি করা হতো। আর সেই পবিত্র মাটিতে বসত করেছিল আর্যরা।

বাংলার আদি বাসিন্দাদের তুলনায় নবীন হলেও আমরা বাঙালিরা বোধ হয় আর্যদের জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হচ্ছি। আর্যরা ভাবত এবং অন্যদের ভাবাতে চাইত, তাদের তৈরি ‘সোমরস’ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পানীয়, সাঁওতালদের ‘হান্ডি’ হচ্ছে পঁচা ভাত। আর্য অহঙ্কার, আর্যদের জাতিগত উদ্ধত্যের উত্তরাধিকারীর মতো কাজ হয়েছে আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলার প্রচলন শুরু হয় ২০১০ সালে প্রণীত একটি আইন দিয়ে, যা পরের বছর সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ক্ষুদ্র কি? ওদের সংখ্যা, না আমাদের মানসিকতা? অভিধানে ‘ক্ষুদ্র’ বলতে বোঝায় ছোট, নীচ, সামান্য, অল্প ইত্যাদি। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলাটা যে তুচ্ছার্থে হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি না।

এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংখ্যালঘু জাতি হলো চাকমা। অন্তত হালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনায় তো বটেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা করলেও চাকমাসহ সেখানকার অন্য আদিবাসীরা পাহাড়ের আদি বাসিন্দা বলেই বিবেচিত হবে। অনেককাল আগে সেখানে কিছু বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাঙালির বসবাস ছিল। পরে সামরিক শাসকদের আমলে পাহাড়ে বাঙালিদের নিয়ে রোপন করা হয়েছে, এই সেটেলাররাই পাহাড়ে কুতর্কের আগুন জ্বালিয়েছে, যাতে তাদের বাস প্রশ্নহীন হয়।

লেখক: ফারহা তানজীম তিতিল, শিক্ষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। 

নিজভূমে পরবাসী

নিজভূমে পরবাসী

যে চিম্বুক পাহাড়কে নিয়ে ম্রো আদিবাসীদের অনেক গল্প-কাহিনী রয়েছে, আজ সেই চিম্বুক পাহাড় ম্রোদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যে চিম্বুক পাহাড় এককালে আমাদেরকে মায়ের সমান আদর আর ভালবাসা দিয়েছিল, আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা মা হারা সন্তানের মত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি।

গত ০৮ নভেম্বরে চিম্বুক পাহাড়ের কাপ্রু পাড়া এলাকায় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে যে মানববন্ধন হয়েছিল আজ তার ১২ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, আমাদের হাতে হাত মিলিয়ে নানা জায়গা থেকে অনেক প্রতিবাদ, মানববন্ধন এবং সমাবেশ হয়েছিল। তাই সর্ব প্রথমে তাদের সকলের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর এটাও আশা করছি আগামীতেও তারা আমাদের সাথে থাকবেন। এত প্রতিবাদ, এত সমাবেশ হওয়ার পরও আমরা আশা করতে পারি না যে, এই জায়গা আমরা নিশ্চিত ফিরে পাবো। তবু মন মানছে না, তাই বসে না থেকে চিম্বুকের পুরনো গল্প মানুষকে শোনাতে চেয়েছি। আর এই পুরনো গল্প মানুষকে শোনাতে পারার মধ্যে নিজের মধ্যে কেমন যেন ভাল লাগা কাজ করে। চিম্বুক পাহাড় সম্পর্কে কোন কিছু লিখতে পারলে নিজেকে মনে হয় অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি। কারণ আমি দেখেছি অনেক ম্রো-ও আজকাল কেমন যেন চিম্বুক পাহাড়ের সমস্যার কথা শুনে না, জানে না। তারা খুব ভদ্র। কারণ তারা কারো বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে চায় না। তাদের চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে কথা বলতে কেমন যেন দ্বিধা। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হয়ে কিছু কথা বলতে পারলে যেন তাদের সব দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। চিম্বুক পাহাড়ের সমস্যার সম্পর্কে লিখতে আমার মন সারাক্ষণ ছটফট করে। আর এই অভ্যাসটা আজকের নয়, অনেক দিনের। কারণ আমি চিম্বুক পাহাড়কে সব সময় আমাদের মাতা জ্ঞান করি। মাতা যেমন আমাদেরকে দুধ দিয়ে বড় করে তোলে ঠিক তেমনি এই চিম্বুক পাহাড়ের আলো-বাতাস খেয়ে আমরা বড় হয়েছি। তাই এই চিম্বুক পাহাড়ের দুর্দিনে আমি চুপ করে থাকতে পারি না। চিম্বুক পাহাড়ের কান্না, চিম্বুক পাহাড়ের আর্তনাদ সম্পর্কে আমি আজীবন লিখে যাবো।

সবেমাত্র বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। অনেকের জুমে ধান পাকতে শুরু করেছে। আমাদের পরিবারের লোকজন জুমে যেখানে ধান পাকছে, সে স্থানে কাটা শুরু করেছে। আমাদের জুম ছিল চিম্বুক রাস্তার পাশে, বলতে গেলে চিম্বুক রাস্তার লাগালাগি। সেই বছর আমাদের চিম্বুক রাস্তায় বিদুৎ তারের পিলার বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। চিম্বুকের রাস্তা ছিল কাঁচা। একদিন আমি মা-বাবা আর ভাই-বোনদের সাথে জুমে কাজ করতে গিয়েছিলাম। আমাদের জুম ছিল ১৪ মাইল দূরত্বে বর্তমান সিংতুই পাড়ার পাশে। আমি জুম ঘরে থাকতাম আর তারা সারিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে জুমের পাকা ধান কাটতো। আমি ছোট বলে আমাকে কাজ করতে হয়নি। আমি জুমের চারদিকে ঘুরি আর মাঝে মাঝে জুমের শসা (ঙুই উই) খাই। মা আমাকে জুম ঘরে থাকতে বলতো কারণ জুমে অনেক বিষাক্ত পোকামাকড় থাকে। জুমের পাকা ধান দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হলাম। জুম ঘরে থাকার আমার কোন ইচ্ছা হতো না। আমার মা-বাবা আর ভাই-বোন গান গেয়ে গেয়ে কাজ করতে থাকে। হঠাৎ বাবা আমাকে জানালেন, চিম্বুক রাস্তায় নাকি গাড়ি আসছে। আমি রাস্তার পাশে গাড়ি দেখতে গেলাম।

কিন্তু গাড়ির শব্দে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি গাড়ি দেখতে পেলাম না। পরে দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়ি দেখতে কেমন? আমি অনুমান করে বললাম, গাড়ি দেখতে জুম ঘরের মত। আমার কথায় তারা অবাক হলেন। আমাদের জুম চিম্বুক পাহাড়ের অনেক উঁচু জায়গায় বলে জুম থেকে চারদিকের অনেক কিছু দেখা যেতো। এসবের মধ্যে রয়েছে লোহাগাড়া বাজার, কক্সবাজারের রাস্তা আর চিম্বুক টাওয়ার। দূর থেকে লোহাগাড়া বাজারের টিনের ঘরগুলো দেখতে চকচক করে। মা বলতেন, এই চকচক করা ঘর নাকি ধনীদের। আমি অবাক চোখে দেখতাম চকচক করা টিনের ঘরের দৃশ্য। আমি ভাবতাম জীবনে এই রকম রূপার মত চকচক করা ঘরে থাকতে পারবো কিনা!

দিদিদের সাথে নানা কথা হতো। বড় বড় ও বেশি চকচক করা ঘরকে নিজের ঘর বলে দাবি করতাম। চিম্বুক টাওয়ারকে আমরা বলতাম ‘এরা ম্রো টাওয়ার’। গ্রামবাসীরা বলতেন, আমাদের এলাকার এরা ম্রো নামের এক লোক সেই টাওয়ার নির্মাণ করেছিলেন। সেই কারণে টাওয়ারের নাম রাখা হয় ‘এরা টাওয়ার’।

একদিন আমি আমার মা আর বাবা এক সাথে গিয়েছিলাম বড় দিদি রিয়েনকে দেখতে পটেসিং পাড়ায়। ওখানে দিদির বিয়ে হয়েছিল। পটেসিং পাড়ায় চিম্বুকের রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। সেবার বাবা আমাকে বললেন, নীলাদ্রি এলাকায় নাকি আর্মিরা ক্যাম্প করবে। তখন সেখানে অনেক জঙ্গল ছিল। আমি বাবার কথায় হেসে উড়িয়ে দিলাম। কারণ এত জঙ্গলে কিভাবে ক্যাম্প করবে। তাছাড়া সেই জায়গা ছিল সিমলোং পাড়া লোকদের। আমাদের জানা ছিল না যে, একজনের জুমের জায়গা আরেকজন জোর করে দখলে নিতে পারে। তাছাড়া মাতার সমান পবিত্র পাহাড়কে বিক্রি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। কারণ এতদিন দেখে এসেছি, আমাদের মানুষ মাতার সমান পবিত্র পাহাড়কে বিক্রি করাতো দূরে থাক, নানা পূজা করে ভগবানের সমান পবিত্র জ্ঞান করে।

সেবার দিদি রিয়েন সিংপাত একটি কেরোসিনের লাইট বান্দরবান থেকে কিনে আনলেন। রাতে লাইট দেখতে দিদিদের ঘরে অনেক মানুষের জমায়েত হলো। তারা আমাদেরকে মোরগ কেটে ভাত খাওয়ালেন। পরে যাওয়ার সময় দুটি মোরগ দিয়ে দিলেন। দিদিদের গ্রাম থেকে আমাদের ঘরে ফিরে আসার পর আমার মুখ আর বন্ধ থাকল না। রাস্তায় এবং দিদিদের গ্রামে যা কিছু দেখলাম তা সবই বন্ধুদেরকে বলতে থাকলাম। সামান্য দূরে যাওয়াকে আমি সারা পৃথিবী ঘোরা মনে করলাম। তখন আমার বন্ধুরা আমার কথা অতি মনোযোগ দিয়ে শুনে।

এর কয়েকদিন পরে আমাদের নতুন বিহারে (ক্রামা মন্দির) কাজ শুরু হয়। গ্রামবাসীরা বিহারের পিলারের জন্য জঙ্গল থেকে বড় বড় গাছ কাটে। পরে সেইগুলো পুরো গ্রামের মানুষ টেনে নিয়ে আসে। আমরা যারা ছোট তারাও অনেক আনন্দে তাদেরকে সাহায্য করি। গ্রামে কারবারী ঘরে সভার জন্য গ্রামে একবার ডাক দিলে গ্রামবাসী হুড়হুড় করে চলে আসে। এর কয়েকদিন পরে আমাদের নতুন বিহারে কলা চারা রোপনের কাজ শুরু হল। বিহারে যিনি থাকেন তিনি আমাদেরকে মজুরী দিতেন, দিন প্রতি সাত টাকা। আমি দুইদিন কলা চারা রোপণ করে চৌদ্দ টাকা পেলাম। এই চৌদ্দ টাকা আমি আর ঘরে রাখার জায়গা পেলাম না। কোন জায়গায় এত টাকা রাখবো তা আমার জানা ছিল না। এক জায়গায় রেখে পরক্ষণে আবার অন্য জায়গায় সরিয়ে রাখতাম। আমার ঐ অবস্থা দেখে আমার দিদি লেংপাও, দিদি রুইচুম আর দিদি সংলেং হাসতে থাকেন। তাদের কাছে হাসার কারণ হলেও আমার কাছে তা ছিল খুবই সত্য। জীবনে এই প্রথম এত অঙ্কের টাকা হাতে পেলাম। তাও আবার নিজের কষ্টের টাকা! এর ঠিক তিন দিন পর দিদি লেংপাও আমাকে তার ঘড়ি দিয়ে দিলেন। ঘড়ি পেয়ে কি যে ভাল লাগল তা বুঝিয়ে শেষ করতে পারবো না। কাটা ঘড়ি হওয়ায় আমি সময় বুঝতাম না। কিন্তু মানুষের সামনে সব সময় ঘড়ি দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

একদিন ঘটল এক হাস্যকর ঘটনা। আমাদের গ্রামের এক লোক বাজারে যাবে বলে আমাকে সময় জিজ্ঞাসা করলো। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা বাজে! সে বলল, এখনতো সবেমাত্র সকাল হয়েছে, তবে কেন এত তাড়াতাড়ি একটা বেজে গেল! সে আমার হাতের ঘড়ি দেখে নিল। সে আমাকে বোকা মনে করল। কারণ তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। সেদিন থেকে লোকটার সামনে যাওয়া আমার কাছে বাঘের কাছে যাওয়ার মত মনে হল। সব সময় তাকে এড়িয়ে চলতাম। তবে তিনি অনেক ভাল লোক ছিলেন। আমাকে ভাল চোখে দেখতেন। তার ছিল একমাত্র মেয়ে। তার নাম তুমলে। একমাত্র মেয়ে বলে তাকে খুব আদর করতেন। আমার মেজো দিদি রুইচুমের সাথে তুমলের ছিল খুব সদভাব। তুমলে, দিদি রুইচুম, চিকইয়ো আর তুমপং তারা একসাথে আমাদের ঘরে ঘুমাতেন। আমার বন্ধু তনসিং, থংওয়ই, তাংলাই, কসাই, প্রেনপং, মেনচ্যং আর পাসাই। তবে পাসাইয়ের ঘর আমাদের ঘর থেকে দূরে ছিল বলে তার সাথে দেখা হত অনেক কম। তুমলেদের ঘরে গেলে তার মা সংলত সব সময় আমাকে ভাত খেতে বলতেন। ভাত খেতে না চাইলেও মাঝে মাঝে খেতেই হতো।

এক শীতের রাতে দিদি লেংপাও, দিদি রুইচুম, তুমপং, তুমলে আমাদের বললো, এই শীতের রাতে গোসল করতে পারবে কিনা! এখানে আরেকটি কথা বলা ভালো যে, আমার বন্ধুসহ আমরা আমাদের ঘরে এক সাথে ঘুমাতাম। সেদিন থংওয়ই আর কসাই দিদিদের কথায় রাজি হয়ে যায়। পরে আমি আর তনসিংও তাদের সাথে রাজি হয়ে গেলাম। জানুয়ারী মাসের রাতে কনকনে শীতের রাতে আমরা গোসল করলাম। রাত তখন দশ কি এগারোটা বাজে। গোসল করে আমরা ঘরে ফিরে উনুনের পাশে আশ্রয় নিলাম। আমার নিজের শরীরকে নিজের বলে ভাবতে পারলাম না। আমার শরীর যেন কোন শরীর না, আস্ত একটা কাঠের টুকরো। নিজেকে মনে করলাম ক্ষণিকের মধ্যে আমি জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবো। পরে উনুনের পাশে প্রায় এক ঘন্টা থাকার পর কিছুটা ভাল লাগল। আমাদের কান্ড দেখে দিদিরা হাসতে থাকে। তবে তাদের হাসার কারণ শেষে পরিণত হলো কান্নায়। সকালে আমাদের ঘটনা শুনে মা বাবা তাদেরকে অনেক গালি দিল। গালি খেয়ে দিদি রুইচুম সেদিন জুমে গেল না। আমি ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট বলে মা-বাবা আমাকে আলাদা চোখে দেখতেন। বিশেষ করে আমার বাবা! আমি নাকি বাবার বাবা রুমতুই হয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছি, তাই বাবা আমার কান্না সহ্য করতে পারতেন না।

দিদি রুইচুম সারাদিন আমার সাথে কথা বললো না। আড়চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাতো। আমি তাকে ডাক দিলেও তিনি না শোনার ভান করেন। আর সাড়া দিলেও রাগের সাথে উত্তর দেন। আমি বুঝতে পারলাম দিদি আমাকে রাগ করেছে।

পরে সন্ধ্যায় জুম থেকে মা-বাবা আর ভাই-বোনেরা ফিরলো। সে রাতে আমরা একটি শুকর জবাই করলাম। জুম কাজে কষ্ট হওয়ায় শুকর জবাই। সেদিন রাতে অতি আনন্দে আমরা শুকর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম।

এর কয়েকদিন পর আমাদের বিহারে যিনি থাকেন তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে গেলেন বার মাইলে (বর্তমান ওয়াই জংশন)। তাঁর নাম লেংইয়াং ম্রো। তিনি ক্রামা ধর্ম পালনের জন্য বিহারে থাকেন। সেবার আমরা লেংইয়াংর সাথে তিনজন গেলাম। আমি, তনসিং আর থংওয়ই। আমাদের গ্রাম থেকে বার মাইলের দূরত্ব ছিল মাত্র ছয় কিলোমিটার। কিন্তু এই সামান্য দূর হলেও সেখানে যাওয়া আমাদের সৌভাগ্য হতো না। সৌভাগ্য মনে করে সেদিন আমরা অতি আনন্দে গেলাম বার মাইলে। আমি সাথে নিয়ে গেলাম আমার কষ্টে উপার্জিত তিন টাকা। বাবা আমাকে বললো, এত বেশি টাকা নিয়ে যাওয়া অনর্থক হবে। আমরা চৌদ্দ মাইল পথ দিয়ে গেলাম। রাস্তায় পৌঁছে আমরা অনেক ভয় পাই। চিম্বুক রাস্তা নতুন করা হয়েছে। সবেমাত্র কারেন্ট তারের পিলার দেওয়া শুরু হয়েছে। বাতাসের সাথে তারের মিলনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়। তা শুনে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। লেংইয়াং আমাদেরকে বললো, ভাগ্য থাকলে গাড়ি দেখতে পাবো।

গাড়ি দেখার জন্য আমাদের মন ছটফট করতে থাকে। রাস্তার আশেপাশে বড় বড় গাছ আর ঘন জঙ্গল ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমাদের গায়ে রোদ লাগতো না। তখনো ভাঙ্গা ইটের রাস্তা ছিল। রাস্তা ছিল খুব ছোট। কারেন্ট তার এখানে সেখানে পড়ে ছিল। গ্রামের যুবকেরা সেই তার কেটে হাতের চুড়ি বানাতো। অনেকে তার নিয়ে গরম করে নিজেদের পছন্দ মতো চুড়ি তৈরী করে। সারা পথ ধরে আমাদের চিন্তা ছিল, গাড়ি দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা! শেষে আমরা বার মাইল বাজারে পৌঁছে গেলাম। দোকানদার সকলেই ছিল ম্রো। লেংইয়াং বাজার করল। বাজার বলতে তিনি আগরবাতি আর লুঙ্গি কিনলেন। আমরা চা খেলাম আর সাথে বিস্কুট। কিন্তু আমাদের মনে ছিল অন্য ভাবনা। সারাদিন যে কষ্ট করে গেলাম তা কি সার্থক হবে! যাত্রা সার্থক করতে অবশ্যই গাড়ি দেখা চাই! এত কষ্ট করে গেলাম কোন কিছু কেনার ইচ্ছা ছিল না। শুধুমাত্র গাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল। পরে বিকাল হলে আমরা গ্রামের দিকে ফিরি। গাড়ি দেখতে না পেয়ে ঘরে ফিরতে হবে! এই কথা ভাবতে কেমন যে খারাপ লাগলো।

আমরা নিরাশ হয়ে ঘরের দিকে ফিরে গেলাম। আর কখন এত দূরের পথে আসতে পারবো কিনা ভাবতে ভাবতে মন খুবই খারাপ হল। হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমরা আমাদের গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনে আমরা দৌঁড় দিয়ে রাস্তায় গেলাম। পাহাড়ী পথে দৌঁড় দিতে আমাদের কোন কষ্ট হল না। লেংইয়াং বলল, এত কষ্ট করে আর রাস্তায় যেতে হবে না। কিন্তু আমরা তার কথা আর মানতে পারলাম না। যে যে রকম পারে দৌঁড় দিয়ে গেলাম রাস্তায়। যার জন্য সারাদিন আমাদের মন অস্থির হয়ে আছে সেটি দেখলাম। একটা ট্রাক চলে আসল। লেংইয়াং নিজেও দৌঁড় দিয়ে আমাদের সাথে রাস্তায় চলে আসলেন। রাস্তা ভাল না হওয়ায় ট্রাক খুব আস্তে করে চললো। হঠাৎ হর্ণ শুনে আমরা ভয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়ি। আমাদেরকে দেখে চালকসহ অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ে। আমাদের দিকবিদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখে চালক আরো হর্ণ দিতে থাকে আর হাসিতে ফেটে পড়ে। গাড়ির ভিতরে কারেন্টের তার ভরা ছিল। পরে গাড়ি চলে গেলে আমরা সারাদিনের কষ্ট সার্থক হয়েছে মনে করে ঘরে ফিরি। ঘরে ফিরে গাড়ির কথা বলতে মুখ আর বন্ধ থাকল না।

আমাদের কথা শুনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম, গাড়িও গরুর মত আওয়াজ করতে পারে। তাতে শুধু যে ছোটরা অবাক হয় তা কিন্তু নয়! বড়রাও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেদিন থেকে কয়েক মাস কেবল মুখ থেকে গাড়ির হর্ণ দেওয়ার আওয়াজ করি। গাড়ির হর্ণের মত আওয়াজ তুলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌঁড়ে যাই। সারাদিন এমনি করে থাকি। আমাদের দেখে গ্রামের লোকজন অবাক হতেন। অনেকে প্রশংসা আর অনেকে বিরক্ত হয়ে বকুনিও দেন। তবে মোটামুটি সবাই অবাক হতেন। কারণ কোনদিন গ্রামের মানুষ গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়নি। আর আমরা গ্রামাবাসীদের অবাক হতে দেখে আরো দ্বিগুণ উৎসাহ পেতাম। আরো বেশি করে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতাম। সাথে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ থাকতো সব সময়। এমনকি রাতে ঘুমের ঘোরেও গাড়ির হর্ণের আওয়াজ করতাম।

আজ আমাদের জায়গা চিম্বুক পাহাড়ে আমরা পরবাসী হয়ে গেলাম। চিম্বুক পাহাড়ে গেলে বাইরের মানুষ আমাদের দিকে বিদেশী মানুষের মত হা করে তাকাতে থাকে। আমাদের প্রাণের চিম্বুক পাহাড় আজ আমাদেরকে কাপুরুষ বলে ধিক্কার জানাতে থাকে। খোঁজ করলে জানতে পারা যায়, এখন সমস্ত চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের জায়গা থেকে বহিরাগত মানুষের জায়গা বেশি হয়ে গেছে। যদিও অনেকে এখনও তা প্রকাশ করেনি। এককালে পুরো চিম্বুক পাহাড়ে শুধু ম্রো’রা বাস করতেন। পরে নব্বই শতকে বম জনগোষ্ঠী সেখানে চলে আসে। এখনও দেখলে সহজে দেখতে পাওয়া যায়, ম্রলং ম্রো পাড়া থেকে থানছি পর্যন্ত শুধু ম্রো’রা বাস করে।

এক সময় যেখানে দিনে একবারও গাড়ি দেখা যেত না, আজ সেখানে হাজার হাজার গাড়ি। আমাদের জন্মভূমি চিম্বুক পাহাড়ে এখন আমরা হয়ে গেলাম পরদেশী। আগে ম্রো’রা ম্রো ভাষা দিয়ে দিন, মাস এমনকি পুরো বছর; জীবন চলতে পারতো। আজ সেই ম্রো ভাষা দিয়ে একদিনও চলতে পারে না। না চাইতে বাধ্য হয়ে অন্য ভাষা বলতে হয়। আজ বার মাইলে অপরিচিত মানুষের ঢল নামে। আজ সেখানে কিছু ম্রো’র দোকান আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আজ আমাদের জন্মভূমি চিম্বুক পাহাড়ে অপরিচিত মানুষের ঢল। একজন মানুষের ঘর ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে আরেকজন ঘর তৈরী করলে কি রকম অনুভূতি হয় আমাদেরও সে দশা হয়েছে। আমাদের ঘরের ন্যায় চিম্বুক পাহাড়কে আরেকজন দখল করে নিল এটা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়। আজ আমাদের সুয়ালক আর টংকাবতী ইউনিয়নের মানুষ কেন এত নিঃস্ব জীবনযাপন করছে? এর উত্তর খোঁজলে খুব সহজে উত্তর পাওয়া যাবে। আমাদের আজ ভাল করে চিন্তা করবার সময় এসেছে। এখনো ঘুমিয়ে থাকলে আর কখন আমাদের ঘুম ভাঙ্গবে? এমনিতে আমাদের গভীর ঘুম আমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ আমরা নিজভূমে পরবাসী হয়েছি। চাঁদের ছোট এক ফালির মত এখন আমাদের টংকাবতী আর সুয়ালক ইউনিয়নের মাটি এক ফালি হয়েছে। সেই ছোট ফালি জায়গাও নানাভাবে বেদখল হচ্ছে। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।

আমাদের জীবন ছিল সাজানো ফুলের বাগানের মত সুন্দর। অথচ আমাদের জায়গা-জমি নানা কৌশল প্রয়োগ করে কেড়ে নিয়ে আমাদেরকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। যে চিম্বুক পাহাড়কে বাঘ-ভাল্লুকের সাথে লড়াই করে আমাদের মানুষ বাসযোগ্য করে তুলেছিল আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা হয়ে গেলাম পরবাসী। যে চিম্বুক পাহাড়ের সাথে আমাদের মানুষদের পরিচিতি ছিল মাতা-পুত্রের মত, আজ সেই চিম্বুক পাহাড়ে আমরা হয়ে গেলাম বাপ-মা হারা সন্তান। সহজ-সরল আদিবাসীদের জীবনে এই ধরনের দুর্যোগ কেন?

সংগ্রাম বিমুখ জাতি সহজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমরা আমাদের অধিকারের দাবি আদায়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাব। তবেই আমরা আবারও আগের মত আত্মসম্মান নিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে পারবো।

লেখক: ইয়াংঙান ম্রো, ম্রো ভাষার প্রথম লেখক ও গবেষক।


গন্তব্যহীন প্রান্তজন

উন্নয়ন ডি. শিরা

আর্জেন্টাইন উপন্যাসিক জুলিও করতেজার ‘দ্য উইনারস’ উপন্যাসে বর্তমান মারণাস্ত্রময় বিশ্ব মানব সভ্যতাকে উদগিরিত ভয়াবহ অগ্নুৎপাতের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে— এরূপ চিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটিতে করতেজার জাহাজের সেইসব একদল যাত্রীর কথা বলেছেন যারা তাদের গন্তব্য কোথায় সেটি তাদের নিজেদের কাছেই অজানা। জাতীয় লটারিতে পুরস্কার জিতে একদল যাত্রী ম্যালকম জাহাজে চেপে রাজধানী বুয়েন্স এয়ার্স থেকে বেরোয়, কিন্তু তারা গন্তব্যহীন। বর্তমান মারণাস্ত্রময় বিশ্ব সমগ্র মানব জাতিকে কি অস্থিরতা, বিভীষিকা আর অনিশ্চয়তা দিয়েছে সেটি উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। জাহাজের যাত্রীরা জানে না তাদের গন্তব্যস্থল, বুঝতে পারে না তাদের ঠিকানা, তারা যেখানে পৌঁছতে চায় সেখানেও তারা পৌঁছতে পারে না, ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই আপন ভুবনে ফিরতে হয়। লেখক অনেকগুলো মানুষকে এক জাহাজের যাত্রী বানিয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য এক, গন্তব্যস্থল অভিন্ন এবং এক বিরাট পরিবারের মতো। যে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মৌল চাহিদা এক।

দেখা যায় উপন্যাসটিতে বাস্তব চিত্র উপমার আকারে উপমিত হয়েছে। একবার জাহাজ এক জায়গায় এসে থামে কিন্তু যাত্রীরা কোনো সমাধান পায় না। ঠিক কী কারণে জাহাজ থামানো হয়েছে যাত্রীরা তা-ও জানে না, বুঝতে পারে না, কেউ যাত্রীদের কথার উত্তর দেয় না। জাহাজের ওয়েটাররা যাত্রীদের ভাষা বুঝে না, তাদের নিকট দুর্বোধ্য তাদের ভাষা। শেষ পর্যন্ত ম্যালকম জাহাজের যাত্রীরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি, আশাহত অবস্থায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে আপন ভুবনে। এ থেকে কী লেখক এটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, মারণাস্ত্রময় বিপদাপন্ন পৃথিবীর অধিবাসীদের সামনে আশার আলো নেই? এই প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি।

২. অমীমাংসীত প্রশ্নের সুরাহা করা উপন্যাসের কাজ নয়। উপন্যাস গল্পচ্ছলে জীবনের সুখ দুঃখের কথা বলে, সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি, সঙ্গতি-অসঙ্গতি তুলে ধরে, পাঠককে নিয়ে যায় অন্য জগতে, ভাবায়। এখানেই উপন্যাসের স্বার্থকতা। গন্তব্যহীনতার প্রেক্ষিতে করতেজার উপমাকারে চলতি বিশ্বের যে প্রামাণিক চিত্র একেঁছেন, অঙ্কিত সেই চিত্রের সাথে দেশের খেটে খাওয়া প্রান্তিক আদিবাসী মেহনতী মানুষের ঠিকানাহীনতার যথেষ্ঠ অন্তর্মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর বাদে প্রান্তিকবর্গীয় মানুষ কোথায়, কোন ঠিকানায়, কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়? জানা নেই। জানা নেই বলেই বলি, আমাদের কোনো লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নেই, নেই মিশন, ভিশন। সম্মুখ অগ্রসর হওয়ার জন্য লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গন্তব্যস্থল থাকা দরকার। নেই, আমাদের কোনোটাই নেই। লক্ষ্যহীনভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা কোথায় যাচ্ছি? কেউ জানি না।

স্বভাবতই কেউ কোথাও যেতে চাইলে আগে স্থান বা গন্তব্যস্থল নির্ধারণ করে, পরে সে অনুযায়ী যাত্রারম্ভ করে। গন্তব্যহীন যাত্রার অন্ত থাকে না। আজকে অবস্থান কাল পাত্র-ভেদে আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ঠিকানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় ছক, নীতি-কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। নেই, আমাদের কোনোটাই নেই। আমাদের পূর্ব-প্রজন্ম আমাদের জন্য মিশন ভিশন ঠিক করে যাননি কিংবা তারা যে ঠিকানায় বা যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন বর্তমানে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাওয়াটা নিছকই যুগের চাহিদাকে উপেক্ষা করার সামিল বলে গণ্য হবে। সময়কে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। সময় ও স্রোত আপন নিয়মে চলে। মানুষকে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে কার্যসিদ্ধি করে নিতে হয়, স্বার্থ উদ্ধার করার কৌশল রপ্ত করতে হয়। নতুন সময় নতুন স্বার্থ সামনে হাজির করে। সময়কে তুচ্ছজ্ঞান করলে যে কেউ সময়েরই অন্তিম আস্তাকুড়েঁ নিক্ষিপ্ত হবে। যেখানে কেউ কারোও খোঁজ রাখে না, খোঁজ নেয় না, খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। এই কালের অমোঘ বাণী।

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে আমাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এগিয়ে যাওয়ার জন্য লক্ষ্য ঠিক করা দরকার। পৃথিবীর উন্নত দেশ, জাতি মাত্রই বিভিন্ন লক্ষ্য, বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। খোদ বাংলাদেশ সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ভিশন ২০৪১ প্রভৃতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। এই সময় আমাদের প্রান্তিক মানুষের বিপদাপন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির ভিত রচনার জন্য সর্বত্র মিশন ভিশন দ্বার করানো উচিত। নাহলে উদেশ্যহীন ভবঘুরে হয়ে পড়ে থাকবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, জাতি। আগামী পঞ্চাশ একশো বছরে কী হবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, প্রথা, রীতিনীতি, শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, সর্বোপরি রাজনীতির? নাকি বড় নৃগোষ্ঠীর (?) সাথে মিশে একাকার হয়ে যাবে সরকার সংজ্ঞায়িত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয়? এই বিষয়ে প্রান্তিক বুধমন্ডলী কী ভাবছেন?

৩. বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি জাতিসত্তার মূল উপাদান, জীয়নকাঠি। যদি জাতিসত্তার সংস্কৃতি-ই না থাকে, না টিকে, হারিয়ে যেতে থাকে তবে অটোমেটিক্যালী জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। যুগে যুগে দেশে বিদেশে এমনই হয়েছে, আগামীতেও এমনি ঘটতে থাকবে। পৃথিবীর যে সকল জাতি আপন সংস্কৃতি ঐতিহ্য লালন প্রতিপালন করে রেখেছে, সেই জাতিসত্তার সংস্কৃতি জাতিকে দিয়েছে অধিকার অর্জনের অনুপ্রেরণা, নতুন মাত্রা, নতুন দিক।

প্রান্তিক আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, প্রথা, সুপ্রাচীন রীতিনীতি অচর্চিত থাকার ফলে অনেক আগেই আদিবাসী জাতিসত্তা বিলীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। জাতিসত্তাকে যদি বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয় তবে সেই বৃক্ষের মূল হচ্ছে সংস্কৃতি, বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মূলের ন্যায় নয়। বৃক্ষের জন্য মূলের মাহাত্ত্ব অত্যধিক। বৃক্ষের কোনো অংশের সাথে মূলের তুলনা চলে না। মূল ব্যতীত বৃক্ষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আদিবাসী জাতিসত্তা সমূহের মূল হচ্ছে আদিবাসী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি যদি না থাকে, না টিকে তবে আদিবাসী জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে কী করে?

আমরা দুঃখভার হৃদয়ে বিদৎ সমাজকে প্রায়শ অভিযোগ করতে দেখি, এই সংস্কৃতি ধ্বংসে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ আছে। উত্থাপিত এই অভিযোগ একদম ফেলনার নয়। বাংলায় প্রচলিত বহুল প্রবাদ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য— ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা’। আমাদের দেশের প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের বেলায় রাষ্ট্রের এহেন আচরণ দৃশ্যমান। আদিবাসী মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা না করে উপরি সংস্কৃতি চর্চায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক একাডেমি স্থাপন কী বার্তা দেয়? তথাকথিত এইসব সাংস্কৃতিক একাডেমি কিংবা সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট নির্মাণ করে কী আদৌ সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব? পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বত্র সেটেলার অনুপ্রবেশ, অবকাশ যাপন কেন্দ্র, মিলিটারি ব্যস ক্যাম্প, লেক-রিসোর্ট নির্মাণ, পাহাড়ি জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে কী সংস্কৃতি রক্ষা করা যায়? এভাবে কোনো জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পায়? কিংবা ঢাকা শহরে বছরে একবার দু’বার আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা করে? বা দেশের বৃহৎ কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ উৎসবে আদিবাসী শিল্পীদের নাচ গানের সুযোগ দিয়ে? না, এভাবে কোনো জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না। অনুষ্ঠানের উপর নির্ভর করে জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পায় না। সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট বা সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না। সংস্কৃতি চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠন করে সংস্কৃতিকে বিশেষ রূপ ও মাত্রা দেয়া সম্ভব নয়।

সংস্কৃতি সর্বজনীন। মানুষের জীবনাচরণের মাঝেই সংস্কতির অস্তিত্ব। মানুষ যা কিছু করে তাই যেহেতু সংস্কৃতি সেহেতু আদিবাসী মানুষ পূর্ব পুরুষের রীতিনীতি প্রথার চর্চা যদি নাই করতে পারে তবে সংস্কৃতি কী প্রকারে টিকবে? প্রশ্নের প্রেক্ষিতে যদি বলা হয়, পার্বত্যাঞ্চলে জুম্ম জাতির স্বতন্ত্র জীবন যাপনের অধিকার না দিয়ে আশির দশকে তদানীন্তন সরকার সেটেলার অভিবাসনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন করে সেক্ষেত্রে কী বলা যায়? জুম্ম জাতির সাংস্কৃতিক শেকড় উপড়ে ডালপালায় জল সেচন করে কী সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে? এভাবে কোনো জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষা করা যায় না, সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের অর্থ হবে সংঘর্ষকে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। সংস্কৃতি রক্ষা চর্চার জন্য স্বতন্ত্র জীবনযাপন অর্থাৎ আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার থাকা চাই-ই চাই। নইলে জাতিসত্তার সংস্কৃতি রক্ষা পাবে না। এই সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রান্তজনের উচিত মিশন ভিশন দাঁড় করানো। ভিশন মিশন না থাকলে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না, দিকভ্রান্ত হবো, দিকভ্রান্ত হয়ে হন্যে হয়ে ঘুরবো, ঘুরবে পরবর্তী উত্তর প্রজন্ম।

৪. বন প্রকৃতি নির্ভর আদিবাসী জীবন। প্রকৃতিকে ঘিরে আদিবাসী জীবন আবর্তিত হয়। তা-ই আদিবাসী মানুষ প্রকৃতির প্রতিটি বৃক্ষরাজি, লতা-গুল্ম, নদী, পশু পাখিকে আপন ভাইবোনের মতো আদর যত্ন পরম মমতায় স্নেহ করে। অতীতে ভাতের বেগারে পড়লেও আদিবাসীদের কখনো তরকারির অভাবে পড়তে হয়নি। বনের লতাপাতা আদিবাসীরা সবজি হিসেবে ব্যবহার করে, ফলে সবজির অভাব সহজেই পূরণ হয়। পাহাড়ের ছোট ছোট ঝিরি-নালা বাঁধ বেধেঁ আদিবাসী মানুষ মৎস শিকার করে। অল্প সময়েই খালয় ভর্তি মাছ মারা যেতো। উৎপাদিত খাদ্য ফুরোলে প্রকৃতি আদিবাসী মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।বন আলু, লতা-গুল্ম খেয়ে আদিবাসী মানুষ জীবন ধারণ করতে পারে।

এই তো গেল আশি নব্বই দশকে যখন গারো পাহাড়ে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয় তখন দলবেঁধে গারো সম্প্রদায়ের লোকজন বন আলু তুলতে যেতো। বন আলু তোলার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। বড় কাপড়ের থলে (গারো ভাষায় যেটাকে বলে দকড়া), ধারালো দা, শাবল আর কোদাল নিয়ে আমিও মায়ের পিছু নিয়েছি, জঙ্গল ঘুরে ঘুরে বন আলুর লতা খুঁজতে সাহায্য করেছি, মা পরিশ্রান্ত হলে মাটি খুড়েছি, এভাবে বন আলু সংগ্রহ করেছি। সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে সেই বন আলু বড় পাতিলে সেদ্ধ করে পরিবারের সবাই রাতের আহার সেরেছি। সকালের বন্দোবস্তও একই। সপ্তাহে অন্তত দু’তিন বার কখনোবা চারদিন গ্রামের পুরুষেরা দলবেঁধে জাল, ফালা, দা নিয়ে বন্য শুকর শিকারে বের হতো। শিকার মিললে মাংস কেটে সবার মাঝে সমানভাবে বণ্টন করা হতো। এভাবে আমাদের অন্নের চাহিদা পূরণ হয়েছে। এ তো আমার দেখা অভিজ্ঞতা। এটিই ছিল আমাদের আদিবাসী অর্থনীতি। কিন্তু এখন আর এসব নেই। ভঙ্গুর হয়ে গেছে সে অর্থনীতি, ফলে গ্রামে টিকে থাকা আদিবাসী মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই আদিবাসী মানুষকে শহরমুখী হতে হয়েছে। শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত আদিবাসী পুরুষেরা শহরের বাসা-বাড়ির দারোয়ান, অফিসের পিয়ন, গার্মেন্টস, বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেয়। মেয়েরা বিউটি পার্লার, বাসা-বাড়ির আয়া, বিভিন্ন অধস্তন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। শহরে পড়ুয়া আদিবাসী শিক্ষার্থীরা টিউশনি, বিভিন্ন সেলসের কাজ করে পড়াশোনার খরচ বহন করে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে শহরে এসে আমরা আমাদের প্রথা, ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে হারাতে বসেছি? গ্রামে অবশিষ্ট থাকা পূর্ব পুরুষের জমি জিরাত খুইয়ে বসতে বসেছি? বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আগ্রাসনের প্রবল জোয়ারে ভাসমান দেশের সংখ্যালঘু জনজাতির মানুষ আগামী দিনে কোন গন্তব্যে পৌঁছাবে? কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়?

৫. আদিবাসী জীবন প্রকৃতির সাথে যেমন আবর্তিত হয় তেমনি পরিচালিত হয় নিজস্ব ব্যবস্থায়। আদিবাসী সমাজে নিজস্ব প্রথা, রীতিনীতি দেখা যায়। যেমন গারো সমাজ ব্যবস্থায় গ্রামে একজন নকমা (গ্রাম প্রধান) থাকেন, যিনি গ্রামের ভালোমন্দ সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদানপূর্বক গ্রাম পরিচালনা করেন। নকমা গ্রামের যাবতীয় শালিসী বৈঠক, ঝুট মীমাংসা করা থেকে শুরু করে নির্ধারণ করে দেন কে কোথায় জুম চাষ করবেন, গ্রামবাসী কখন পূজা-অর্চনা, উৎসবাদি পালন করবেন প্রভৃতির তারিখ ঠিক করেন। এই নকমাদের নেতৃত্বেই গারোরা সংগঠিত হয়েছেন, ইংরেজ জমিদার জোতদার মহাজনের শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত লড়াই গড়ে তুলেছেন। তদানীন্তন বৃটিশ সরকার যখন গোয়ালপাড়া, কামরূপ, খাসি হিলস ও বাংলাদেশের গারো অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বাইরে রেখে গারো হিলসের সীমারেখা নির্ধারণ করেছিলেন তখন গারোরা বৃটিশের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি।গারো হিলস বা মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত করা গারো অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো গারো হিলসে অন্তর্ভূক্ত করে পৃথক রাজ্য, আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সোনারাম আর সাংমার নেতৃত্বে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। সেই সংগ্রামে গারো গ্রামের নকমারা আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছেন। আঠারো শতকে ছপাতি নকমা গারো পাহাড়ের গারো, হাজং, কোচ, ডালু, মেচ, হাড়ি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীকে ইংরেজ পোষ্য জামিদার জোতদারদের শাসন শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।যদিও রাজনৈতিক এই সংগ্রাত আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই রাজনৈতিক আন্দোলন গারো সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এখানেও দেখা যায়, গারো সমাজপতি নকমার অসামান্য অবদান।

বর্তমানে ভারতের গারো সমাজে নকমা কাঠামো দেখা গেলেও বাংলাদেশের চলতি সমাজ ব্যবস্থায় নকমার অস্তিত্ব নেই, থাকলেও নামে মাত্র, নখ দন্তহীন বাঘের মতো। পাকিস্তানি আমলে গারো ময়মনসিংহের পাঁচ সীমান্তবর্তী থানা স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা খোয়ালে এখানকার অ-বাঙালি জাতিগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,  সাংস্কৃতিক দিকে থেকে প্রবল আগ্রাসনের মুখে পড়ে। আদি নকমা, মোড়ল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।ভেঙ্গে পড়াটাই স্বাভাবিক কেননা পুরো ভবন যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন দ্বারপাল কেবল দ্বার রক্ষা করতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে একটি জাতিগোষ্ঠী অপরিচয়হীন বা দেওলিয়া হয়ে পড়লে সেই জাতিগোষ্ঠীর অন্যান্য সকল পরিচয় বানের জলের ন্যায় ভেস্তে যাবে, এতো সহজ ব্যাপার।

লেখক : উন্নয়ন ডি. শিরা, প্রবন্ধকার।


শখের মোচ বৃত্তান্ত, মোচের বিড়ম্বনা

পরাগ রিছিল

ড্রাইভারদের সরকার যেমন লাইসেন্স দেয় বিশ্বরোড বা সারাদেশের রাস্তাঘাট দিয়ে গাড়ি চালাবার, রতন মামাদের লাইসেন্স দেয় সারাদেশের ডোবা-নালা-বাড়ির পিছন দিয়ে পথ চলবার। এই পথ চলা যে একপাল ওয়াক নিয়ে-! ডোবানালার কচুঘেঁচু খেতে খেতে, ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দে পথ চলতে থাকে একপাল ওয়াক। খাইয়ে খাইয়ে, তাড়িয়ে তাদের সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় রতন মামাদের মতো দু’তিনজন মানুষ। তাদের সাথে কথা বলবার একটা নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে। এই প্রজাতির সাথে সে ভাষাতেই কথা বলেন রতন মামারা। তাদের ভাষা ঠিক বুঝতে পারেন ওয়াক বা শূকরেরর পাল।

কথা সেইটা না, কথা হচ্ছে রতন মামার অনন্য মোচ। সেই মোচ বা গোঁফ ঘিরে রতন মামার জীবনে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব সব ঘটনাবলি। যেগুলোর কোন কোনটি অপ্রত্যাশিত, অপ্রস্তুতকর, কোনটি লোমহর্ষক! এই সর্বশেষ অভিজ্ঞতা যেমন, হলি আর্টিজানের হামলার পরপর। তখন দেশের কিছু কিছু স্থানে হত্যার হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি দেয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। হত্যার হুমকিসহ তেমনি এক চিঠি পেয়েছিল রতন মামাদের এলাকার মিশনের ফাদার। ঠিক সে সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ভায়রার ছেলে। ছেলের নাইটের গাড়িতে আবার ঢাকা ফিরবার কথা। গ্রাম থেকে নিয়ে আসবে নানা ফসল-সবজি। সেগুলো ভরতে ভরতে শেষমেষ দুই বস্তা হয়ে গেল। মাঝরাতে ভায়রার পুত্রের সেগুলো নিয়ে একা একা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছা কষ্টকর। রতন মামা বললেন, ঠিক আছে সমস্যা নেই, আমি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিব। ফেরার পথে একা হবেন বলে ভায়রা বললো, আমিও সাথে যাই। নাছোড়বান্দা ভায়রা গেলেন সাথে। বিপত্তিটা ঘটল বাসস্যান্ড থেকে ফেরার সময়।

রাস্তায় মিশন গেটের কাছে পৌঁছতেই অস্ত্র তাক করে পুলিশ ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে। এত রাত্রে কোথা থেকে আসছো? রতন মামা বললেন, বাসস্ট্যান্ড থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে মামার কথা তার বিশাল মোচটির জন্য। এতোএতো করে বলছেন, তাও বিশ্বাস হচ্ছে না! সবশেষে পুলিশ বললো- কিছু খাইসো? রতন মামা এবার গায়ের শার্ট খুলে পেটের কাছে ‘অপারেশনের দাগ’ দেখিয়ে বললেন- স্যার, আমার শরীরের যা অবস্থা, এই শরীর নিয়ে কিছু খাওয়া যায়? পেটের দাগটা দেখে মন নরম হল পুলিশের, সে যাত্রায় মিললো মুক্তি!

একবার শীতের সময় বাড়ি থেকে দূরের গাবতলী বাজারে জমজমাট মেলা চলছে। সারা এলাকায় মাইকিং হয়েছে। দিনরাত চলছে মেলা। এলাকার অনেকজন ঘুরে এসে নানা গল্প শোনাচ্ছে সেই মেলার। দীপক পালের মুখাবয়বেও তখন লম্বা মোচ ছিল। দীপক পালের মোটরসাইকেল আছে। দীপক পাল আর রতন মামা দু’জন মিলে ঠিক করলেন, যাবেন মেলা দেখতে। সারাদিন মেলা দেখে ফিরে আসবেন বিকেলে। ভোর চাটটায় শুরু করলেন যাত্রা। সে রাস্তায় বন-জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়। জঙ্গল পেরিয়ে মেইন রোডে উঠতেই আটকালো পুলিশের একটি গাড়ি। “তোমরা কি ডাকাত? এত ভোরে এই জঙ্গলের রাস্তা থেকে বেরুলে?” “আমরা পুলিশরাই রাতে এই রাস্তা এড়িয়ে চলি- ” জেরা চলছে। স্যার, আমরা ডাকাত নই তবে বলতে পারেন আমাদের সাহস আছে! রতন মামা বললেন, স্যার ডাকাত দলের সামনেও যদি পড়তাম, তাহলেও তারা আমার মোচের দিকে তাকাতে তাকাতেই তো আমরা তাদের পিছনে ফেলে দশ হাত সামনে চলে আসতাম…। পুলিশ স্বীকার করল, তা অবশ্য ঠিক! পুলিশের কাছে ব্যখ্যা করে জানালেন, তাদের যাত্রার উদ্দেশ্য, মেলার কথা। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেড়ে দিল।

শূকরের ব্যবসা করতে গিয়ে রতন মামার ঘুরা হয়েছে সারা বাংলাদেশ। পাবনা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নাটোর, কালীগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও- হিলি, চলনবিল। যমুনা ব্রীজ হওয়ার আগে হেঁটেহেঁটে দেশের নানা জায়গায় পৌঁছতে লেগে যেত পনের -বিশদিন থেকে এক-দু’মাস। ব্যবসা বলতে, মহাজন আগেই টাকা বা অনেকগুলো শূকর দিয়ে দিতেন, সেগুলো চরিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে বিক্রি করে মহাজনকে টাকা ফেরত দিতে হতো। লাভসহ মহাজনের টাকা ফেরত দিয়ে যেটুকু বাকি থাকে, কেবল সেটুকু নিজের।

এক সময় এই ব্যবসায় জড়ালো তার তরুণ দুই ছেলে। জড়ালো বলতে একস্থানে জড়ো করে রাখা শূকরের পাল থেকে দুই-তিনটা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে হকারের মত বিক্রি। বাবা যে দামে তাদের বিক্রি করতে বলে দেয় তারা তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করে চলে আসে। বাবা যদি বলে দেয়, এগুলো তিন হাজার টাকায় বিক্রি করবে, তারা দুই হাজার টাকায় বিক্রি করে চলে আসে! কয়েকমাস পর তার ছেলেরা যেসব গ্রামে ওয়াক বিক্রি করতে গিয়েছিল রতন মামা নিজে গেলেন সেসব গ্রামে ওয়াক বিক্রি করতে। রতন মামার কাছে ক্রেতারা জানতে চায়, এই ওয়াকেরর দাম কত? রতন মামা বলে তিন হাজার। ক্রেতারা সবাই বলে, “তুমি ভাল না” “তুমি বেশি বেশি দাম চাও।” তার কাছে জিজ্ঞেস করে, “আগে ঐ দুইটা ছেলে যে আসতো ওরা কই? ওরা ভাল, কম দামে বিক্রি করতো।” রতন মামা তার ব্যবসা লাটে ওঠানো দুই ছেলের কথা রাগে মনে মনে স্মরণ করে কষ্টচেপে উত্তর দেয়, ” ওরা কম দামে বিক্রি করতে পারে, ওরা যে তাদের বাপের সম্পত্তি বিক্রি করে!” রতন মামার ঝুলিতে রয়েছে এমন দম ফাটানো বাস্তব জীবনের গল্পও।

ছোট পিকআপে করে যখনই রতন মামা দূর-দূরান্তে একস্থান থেকে আরেক স্থানে ওয়াকের বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় ব্রীজ পার হতেন, প্রতি ব্রীজেই মামাকে আটকানো হতো তার কিম্ভূতদর্শন লম্বা মোচের জন্য। সদুত্তর দিয়ে পার হতে হতো। কমন একটা উত্তর ছিল, ” আমার শখ, আমার আছে তাই আমি রাখছি। আপনার নাই, আপনি রাখেন নাই। আপনার কোন শখ থাকলে আপনি তা পূরণ করার চেষ্টা করেন না?”

মামাকে জিজ্ঞেস করি, এই মোচটার জন্য কতবার পুলিশ ধরল আপনাকে?

– অনেকবার…।

হিসেব করে বের করতে কষ্ট হয়।

এত বিড়ম্বনা যে পোহাতে হয়, কখনো রাগ করে এমন মনে হয়নি যে, ধুর! মোচটাই ফেলে দেই?

– না, একবারও না।

মোচ কেবলই কি বিড়ম্বনাই ডেকে এনেছে মামার জীবনে? কোন সুবিধা বয়ে আনেনি? কিছু সুবিধা এনেছিল বটে! সাগরদিঘা, নারায়ণগঞ্জে বড় বড় সাধুদের সাথে একত্রে বসতে পেরেছেন। জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলার মাজার, শাহজালালের মাজারে গিয়েও এই মোচটার জন্য আলাদা সম্মান পেয়েছেন। সখীপুরের এক মন্দির, যেখানে বসে গুপ্তবৃন্দাবন, বয়সী লোকদের সচরাচর যেখানে ঢোকার অনুমতি মেলে না। কেবল মোচের জন্যই যত্ন করে মামাকে সেখানে নিয়ে বসিয়েছেন!

জগতের সকল মানুষের শখের জয় হোক।

লেখক: পরাগ রিছিল, কবি ও গবেষক।

গসপেল ত্রিপুরা প্রচার করবে জীবন জয়ের সুসমাচার

পরাগ রিছিল

গসপেল ত্রিপুরার বাড়ি বান্দরবান রুমার হিপিহিল পাড়া। বাবা যোহন ত্রিপুরা, মায়ের নাম সাইনিমা। কেমন করে গসপেল চলে এলেন দূর গারোভূমে? আদিবাসীদের চেহারায় মিল থাকার কারণে চেহারা দেখে পার্থক্য করাও তো দায় কে ত্রিপুরা কে গারো । চলুন সেসব প্রশ্নের অনুসন্ধানেই নামা যাক।

গসপেল ত্রিপুরাদের বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব প্রায় একদিনের পথ। তার কথায় বোঝা গেল সেখানে জীবনযাপনটা একটু কঠিনই। তার ভাষায়— ‘আমাদের দিকে তো পাহাড় টিলা এলাকা’। এরমধ্যে গসপেল ত্রিপুরা বুঝতেও শুরু করে, ‘আমরাতো গরীব, টাকা পয়সার অভাব’। সংখ্যায় ভাইবোনেরাও বেশি, চার ভাই, তিন বোন। রুমার বেরশেবা ত্রিপুরা হোস্টেলে দু’বছর থেকেছিল গসপেল। সেখানে বাৎসরিক খরচ ১৪,০০০ টাকা। পড়াশুনারত অন্যান্য ভাইবোনদের পেছনেও যদি খরচ হয় এই পরিমাণ টাকা, জুমচাষ করা গরীব বাবা-মা’র পক্ষে কিভাবেই বা সম্ভব তাদের সন্তানদের পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন করা?

গসপেলের এক বড় বোন পড়াশুনার জন্য আগেই চলে এসেছিল গারোভূমে। পরবর্তীতে সেই নিয়ে আসে গসপেলকে। দুই ভাইবোন দুইটি মান্দি পরিবারে থেকে পড়াশুনাটা এগিয়ে নিচ্ছে। বিনিময়ে বড় বোন স্কুলের সময়ের বাইরে করে দিচ্ছে সেই পরিবারের বাড়ির কাজ। গসপেল যে পরিবারের সাথে থাকে, সেই পরিবারের রয়েছে ব্যস্ত একটা চা-মুদির দোকান। স্কুলের সময়ের বাইরে গসপেল কাজ করে সেই চা-মুদির দোকানে। গসপেলকে কি বলব আমি? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কষ্টের কথা? ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের কষ্টের কথা? মনে মনে ভাবি, পরক্ষণেই চিন্তা আসে, তার কাছে এইসব কথা বলা, বয়সী এক বড় ভাই হিসেবে আমারই ছেলে মানুষী হয়ে যাবে নাতো?

কারণ সে নিজে ছোট। কাজ করে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে কঠিন বাস্তবতার ভেতর। পড়ছে সবে ক্লাস এইটে। বড় বোন ক্লাস নাইনে, কারণ ইতোমধ্যে বাবার অসুস্থতা আর হোস্টেলে ঝামেলার জন্য পড়াশুনায় গ্যাপ হয়ে গেছে ২ বছর। পড়াশুনায় বরাবর ভাল গসপেল ত্রিপুরা। ক্লাস টু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সে ছিল ফার্স্টবয়। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হয়েছিল রুমা বাজার আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে মা-বাবা নিজভূম ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয় এই দূর গারোভূমে। সদা হাসিখুশি, ভদ্র-বিনয়ী গসপেলকে পছন্দ করে দোকানের সব কাস্টমার। গসপেল হাসিমুখে কাস্টমারদের কাউকে সম্বোধন করেন মামা, আচ্ছু, কাউকে দাদা।

গসপেল তার পড়াশুনার রেজাল্টে নিজে সন্তুষ্ট নয়। আত্মবিশ্বাস রয়েছে, তার রয়েছে আরো ভাল ফলাফল করার সক্ষমতা। একথা তাকে আশ্রয় দেয়া দোকানিও স্বীকার করলেন, ও পড়াশুনার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। একা তার পক্ষেও দোকান সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বাড়িতে স্ত্রী আর তাদের ছোট এক সন্তান। রান্নাবান্না সামলিয়ে স্ত্রীও সাহায্য করেন দোকানে।

তারপরও দোকানিকে অনুরোধ করি, হাসিমুখের ছোট বালক গসপেলকে সময় সুযোগ মতো পড়াশুনার সময়টা যাতে বাড়িয়ে দেন। তিনি উত্তর দেন, সে চেষ্টাতে দোকানের কাজের জন্য লোক খুঁজছেন।

তাদের উভয়ের ভাল হোক! কারণ গসপেল ত্রিপুরার আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য দেখে বুঝে গেছি সে অদূর ভবিষ্যতে প্রচার করবে জীবন জয়ের সুসমাচার।

 লেখক: পরাগ রিছিল

লালটান পাংখোয়া, চট্টগ্রাম থেকে ফিরে

পাংখোয়া

লালটান পাংখোয়া পূর্ব-পশ্চিম বিডি‘র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে, তৃতীয় বর্ষে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যায় পাংখোয়া জাতির লোকজন তিন হাজারের কাছাকাছি। তাঁদের বেশিরভাগ বসবাস করেন রাঙামাটিতে। কিছুসংখ্যক বান্দরবানে। লালটান পাংখোয়ার পরিবার বসবাস করতেন বান্দরবানের রুমা উপজেলায়। লালটানের জন্ম সেখানেই। সাত ভাইবোনের মধ্যে ছোট দুই বোনের জন্ম তখনো হয়নি। বাবা চাকুরি করতেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বরতলী এলাকায়। দুর্গম এলাকা বলে পরবর্তীতে লালটানের পরিবার শিফট হয়ে চলে আসে রাঙামাটির পাংখোয়াপাড়ায়। বাবা বিদ্যালয়ের চাকুরিটা ছেড়ে দেন। পরে কাজ নেন ব্যাংক এশিয়ায়, বর্তমানে আছেন চট্টগ্রামের অক্সিজেনে। মা গ্রামে বাগান দেখাশোনা করেন।

পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিলেন লালটান পাংখোয়া ভর্তি হোক সমাজতত্ত্বে আর পারিবারিক বন্ধু, পড়াশোনার উৎসাহদাতা বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান বখতিয়ার আহমেদ চেয়েছিলেন ভর্তি হোক নৃবিজ্ঞানে। কিন্তু “সাংবাদিকতা ভাল লাগে- ভাল লাগবে” বলে লালটান ভর্তি হলেন সাংবাদিকতা বিভাগে। অর্থনীতি ছাড়া যদিওবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সর্ম্পক, সমাজতত্ত্ব সুযোগ ছিল চারটি বিভাগে ভর্তি হবার।

পাংখোয়াদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে প্রথম বেরিয়েছেন রামভাই পাংখোয়া বেশি বছর হয়নি। তিনি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাংখোয়াদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মিল্টন কেরি, লালটান এবং নাথান এল রোনাল্ড মোট তিনজন পড়াশোনা করছেন। তাঁরা পরস্পর কথা বলেন পাংখোয়া ভাষাতেই। ‘পাংখোয়া এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ কাজ করে পাংখোয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি লালটান সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নিচ্ছেন।

স্বাভাবিকভাবে পাংখোয়া জাতির সবাই আর বন্ধুবান্ধব- শুভাকাঙ্ক্ষীরা অধীর অপেক্ষায় আছি, কখন নিউজে ‘বড় হেডলাইন’ আর তার পাশে চোখ বড় বড় করে দেখব লেখা— লালটান পাংখোয়া, চট্টগ্রাম থেকে ফিরে…

লেখক: পরাগ রিছিল, কবি ও গবেষক। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব

কার্ল মার্কস প্রথম বিচ্ছিনতা (alienation) প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। মার্কসের মতে এই বিচ্ছিন্নতা হল এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যা একজন মানুষকে একটি অর্থপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। অর্থাৎ একজন মানুষ যখন আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন, সামাজিক ব্যবস্থা, সংগঠন, নিজের শ্রমের সাথে একাত্ম হতে পারে না তখন সে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করে। এভাবে বোঝা আরো সহজ, যখন আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র জনগণের সঙ্গে আধিপত্যের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে তখন জনগণের মধ্যে বিচ্ছিনতাবোধের জন্ম হয়। এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের সাথে জনগণের সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও মার্কস শ্রমিক শ্রেণিকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর তত্ত্বকে উপযোগী করেছেন। কিন্তু এ বিচ্ছিনতার ধারণা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং বড় সংকটও বটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এই বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বকে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ব্যয়বহুল সামরিক শাসন জারি রেখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য কায়েম করার সর্বোচ্চ চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চলে একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখা হয়েছে অন্যদিকে উন্নয়নের নামে স্থানীয়দের সংস্কৃতি, ভূমি, জীবন-জীবিকার উপর আগ্রাসন চলছে।

ধরেন, পুঁজিবাদী সমাজে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হলো কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের নিপীড়িত, বঞ্চিত জনগণ, শ্রমিক-কৃষকের ভাগ্যের কি কোনো বড় পরিবর্তন হবে? শ্রমিক-কৃষকের ছেলে মেয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সক্ষম নয়। এবং শ্রমিক-কৃষকের সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অবস্থা এই বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা ও কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ব্যতিক্রমী উদাহরণও আছে নিশ্চয়্ই যেখানে শ্রমিক-কৃষকের ছেলেমেয়ে মেধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়।

নিংসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ও একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের মানুষের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। কিন্তু সমাজে যদি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার শর্তগুলো তৈরি না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে কতটুকু অবদান রাখতে পারে সেখানে বড় সন্দেহ থেকে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষেত্রেও একথা সর্বাংশে সত্য। বাংলায় প্রবাদ আছে যে, ‘‘বেল পাকলে কাকের কি লাভ?’’ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হারে পর্যটন, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হচ্ছে তাতে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের কি লাভ? পাহাড়িদের ঘরের উঠোনে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে অথচ পাহাড়ের সন্তানরা প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরুতে পারছে না ।

২০১২ সালে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে অর্থাৎ ৫ম শ্রেণীতে উঠে প্রায় ৫৯ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে যা কিনা সারা দেশের গড় হারের পুরো দ্বিগুণ।’’ এবং ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রথম আলো পত্রিকায় উঠে আসে ‘৭৫০ শিক্ষার্থীর মাত্র দুজন শিক্ষক।’ যা কিনা রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার একমাত্র সরকারি স্কুল ।

এই বছরের শুরুর দিকে ‘কলেজটি নামে মাত্র স্নাতকোত্তর’ শিরোনামে প্রথম আলোয় উঠে আসে।কলেজটি বান্দরবান সরকারি কলেজ। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এই কলেজের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক থাকার কথা ৯০ জন। অথচ জাতীয়করণের পর থেকে উচ্চমাধ্যমিকের জনবল নিয়েই চলছে কলেজটি। বর্তমানে মাত্র ৩২ জন শিক্ষক দিয়েই চলছে পাঠদান।’

গত ৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হারের এই পরিসংখ্যান দেখুন—

পাশের সন     খাগড়াছড়ি (পাশের হার)      রাঙামাটি            বান্দরবান

২০১৯         ৪৯.৯৩%                   ৪৫.৫০%            ৫৯.৭১%

২০১৮         ৩৬.৬১%                   ৪৫.৯৯%            ৬২.৩১%   

২০১৭         ৪৪.৬৩%                   ৪৫.৮৯%            ৫৫.২২%

এই হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার করুণ অবস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাইমারি-মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন না করে, পাহাড়ি সমাজের উপযোগীতা বিচার ও মতামত না নিয়ে আপনি হুর হুর করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে যাবেন কেন? এটা তো রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কান্ডজ্ঞানহীনতা অথবা সবকিছু জেনেও নির্লজ্জের মত অস্বাভাবিকতা।

এই মাসে (অক্টোবর  ২০২০) কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা বিভাগ খোলা হয়েছে। এর আগেও বিদ্যাসাগর, বর্ধমান ও পুরুলিয়ার সিধু কানহু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা নিয়ে পড়ানো হত। এ বছর থেকে যাদবপুরে সাঁওতাল ভাষায় পড়ানো শুরু হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বৈচিত্র‌্যপূর্ণ জাতিসত্তাসমূহের ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য জন্য আলাদা বিভাগ ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট খুলতে পারতো। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জায়গা দখল করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রতিযোগিতার প্রয়োজন পড়তো না।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করে। এই শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষা ব্যবস্থা সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে তিন সার্কেলের প্রধান তিন রাজা, রাজাদের অধীনস্থ তিন হেডম্যানকে ও রাখা হয়। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মিডল ইংলিশ স্কুল ও ইংরেজী হাই স্কুল স্থাপন করে। এসব স্কুলে প্রাথমিক ভাবে বাংলা ও ইংরেজীর পাশাপাশি চাকমা ও মারমা ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলন রাখা হয় এবং সীমিত সংখ্যক আসনের হলেও দূরদূরান্ত থেকে আগত পাহাড়ী ছাত্রদের জন্য নিরখরচায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বর্তমান সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পিছিয়ে পড়া জাতিসত্তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন। এছাড়া জাতিসত্তাসমূহের ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ‘জাতিসত্তাসমূহের ভাষা একাডেমী’ও সময়োপযোগী দাবী। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাই বরাবরই এসব বিষয়ে কর্ণপাত করেনি এবং যতটা সম্ভব উদাসীন থেকেছে।

আদিবাসী জনগণের দাবির মুখে ২০১৭ সাল থেকে ৫ টি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বই বিতরণ ও কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলেও এখনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাজ প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বান্দরবান জেলা পরিষদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে ২৫% বিনিয়োগ করেছে এবং সম্প্রতি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করেছে। রাঙামাটির সাজেকেও জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্থানীয় জনগণের স্কুলের চাহিদাকে উপেক্ষা করে মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ আইন অনুযায়ী তাঁদের কাজ ছিল শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢেলে সাজানো ও মজবুত করা। বর্তমানে এই অনির্বাচিত ক্ষমতাসীন দলের জেলা পরিষদ এখন দুর্নীতির আকড়ায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পাহাড়ি জনগণ ক্ষোভে এর নাম দিয়েছে ‘জ্বালা পরিষদ’। সারাদেশে ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় অথচ এগুলো ২২ বছর ধরে অনির্বাচিত। একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক কিংবা পরিষদের অন্যান্য বিভাগের চাকরির জন্য পরিষদের সদস্যদের বাধ্য হয়ে ঘুষ দিতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। বিভিন্ন মিডিয়া মারফতে এসব দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন, পর্যটন, বিশ্ববিদ্যালয় হলে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করা হয়। ইতিমধ্যে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য পাহাড়ি অধ্যুষিত ঝগড়াবিল মৌজার  ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং স্থানীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ ও শেষ পর্যায়ে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বহিরাগতদের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। একজন পাহাড়ির ঘরের উঠোনে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে অথচ তাঁর কোনো স্বার্থ নেই, সম্পৃক্ততা নেই, অনুভূতি নেই। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তাঁর ভিটেমাটিও কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তাঁকে প্রান্তিকতার শেষ সীমানায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ি জনগণের জন্য এর থেকে বড় বিচ্ছিন্নতা আর কি হতে পারে?

রাষ্ট্র যদি ক্রমাগত এই বিচ্ছিন্নতাকে ধরে এগোতে চায় তাহলে বলবো তাঁরা ভুল পথে হাঁটছে। পাকিস্তান ভেঙে দু’টুকরো হওয়ার ইতিহাস যেন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা ভুলে না যায়। কারণ পাহাড়ি জনগণের এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। রাষ্ট্র ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার পথে হাটবে আর পাহাড়িরা হাটবে শান্তি-সম্প্রীতি উন্নয়নের পথে। কি চমৎকার চাটুকারিতা! সভ্য সমাজে কথা দিয়ে কথা না রাখা, বিশ্বাসঘাতকতা করা,  চাটুকারিতা করা বেমানান ।

দীর্ঘ পাঁচ দশক পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তি-সম্প্রীতি উন্নয়নের আশ্বাসে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আর নয়।

লেখক: রোনাল চাকমাছাত্রনেতা। 

© all rights reserved - Janajatir Kantho